নিয়ম : রক্তের পরিসঞ্চালন ব্যবস্থা নিরাপদ করতে ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদে একটি আইন করা হয়েছে। এ আইন অনুযায়ী, তৈরি করা হয়েছে জাতীয় নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন বিধিমালা। এ বিধিমালায় দেশে রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র স্থাপন, পরিচালনা ও রক্তদাতার বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনা অমান্য করলে রয়েছে শাস্তির ব্যবস্থাও। বিধিমালা অনুযায়ী, রক্ত সঞ্চালন কেন্দ্র স্থাপন করতে হলে আগে ওষুধ প্রশাসন থেকে অনুমোদন নিতে হবে। এর জন্য ডাক্তার, টেকনিশিয়ান থাকতে হবে। রক্ত সংগ্রহের আগে দাতার রক্ত স্ক্রিনিং/ক্রসম্যাসিং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার যন্ত্র থাকতে হবে। এ ছাড়া হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, সিফিলিস, ম্যালেরিয়া ও এইচআইভি রোগের পরীক্ষা অবশ্যই করতে হবে। রক্ত সংগ্রহের পর তা স্বাস্থ্যসম্মত ও দূষণমুক্ত পরিবেশে সংরক্ষণ করতে হবে। এ জন্য থাকতে হবে বিশেষ ধরনের ফ্রিজ। এতে ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রক্ত সংরক্ষণ করতে হবে। সংগৃহীত রক্ত পাঁচদিনের মধ্যে ব্যবহার করতে হবে। পাঁচদিন পর রক্তের কার্যকারিতা নষ্ট হতে থাকে।
রক্তের চাহিদা ও ঘাটতি : রাজধানীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ৪৫টি রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সবগুলোই সরকারি ও বেসরকারি খাতের বড় বড় হাসপাতালের। এর বাইরে রয়েছে সন্ধানী, বাঁধন, রেড ক্রিসেন্ট, কোয়ান্টামের মতো কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, যারা রক্ত সংগ্রহ করে এবং রোগীদের চাহিদা অনুযায়ী বিনামূল্যে সরবরাহ করে।
বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৮ থেকে ৯ লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। কিন্তু ব্লাডব্যাংকগুলোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৫ থেকে ৬ লাখ ব্যাগ সংগ্রহ করা হয়। অর্থাৎ ৩ থেকে ৪ লাখ ব্যাগ ঘাটতি থেকে যায়। এই ঘাটতি পূরণ হয় পেশাদার রক্তদাতাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা রক্তের মাধ্যমে, যার বড় অংশই কোনো না কোনোভাবে দূষিত থাকে।
রক্তের কালো ব্যবসা : ঘাটতি রক্তের চাহিদা মেটাতে গিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে কালো ব্যবসা। রাজধানীর শ্যামলী, মোহাম্মদপুর, হাতিরপুল, চানখাঁরপুল, মহাখালীসহ বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে অবৈধ ব্লাডব্যাংক বা রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র। এগুলোতে নিয়ম অনুযায়ী ডাক্তার নেই, নেই টেকনিশিয়ান, আধুনিক যন্ত্রপাতিও বলতে গেলে নেই। রক্ত সংগ্রহ করে তারা সাধারণ ফ্রিজে রাখে। ফলে রক্তের মান বজায় থাকে না। চানখাঁরপুলের ক্রিয়েটিভ ব্লাড সেন্টার, লালমাটিয়ার ধানম-ি ব্লাড সেন্টার ও শ্যামলীর ফেমাস জেনারেল হাসপাতালের ব্লাডব্যাংকে পর্যাপ্ত বেড, রক্ত সংগ্রহ ও সংরক্ষণের সরঞ্জাম নেই। এগুলোতে সাধারণ ফ্রিজে রক্ত রাখার নজির রয়েছে।
অবৈধভাবে ব্লাডব্যাংক পরিচালনার দায়ে মোহাম্মদপুরে সেবিকা ব্লাডব্যাংকে ও সন্ধি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান চালিয়ে জেল-জরিমানা করেছে র্যাব। নখাঁরপুল জেনারেল হাসপাতাল, আলকেমি মেডিক্যাল সেন্টার, আনন্দবাজারের লাইফ সেফ ব্লাডব্যাংক, নাজিমউদ্দিন রোডের ক্রিয়েটিভ ব্লাডব্যাংকেও বে আইনিভাবে রক্ত ব্যবসা করা হচ্ছে। এসব স্থানে পর্যাপ্ত টেকনিশিয়ান, রক্ত সংগ্রহের সরঞ্জাম ও ব্যাগ নেই। কোনো ডোনারও নেই। নিয়ম অনুযায়ী ব্লাডব্যাংকগুলোতে রক্তদাতাদের একটি তালিকা থাকতে হবে। তারা ছয় মাস বা এক বছর পর-পর স্বেচ্ছায় রক্ত দেবেন।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. আসাদুল ইসলাম বলেন, অবৈধ রক্ত ব্যবসা জরুরিভিত্তিতে বন্ধ করা উচিত। এর মাধ্যমে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে। আর রোগীর আত্মীয়স্বজনকেও সচেতন হতে হবে যাতে তারা পেশাদার রক্তদাতাদের রক্ত গ্রহণ না করেন।
তিনি আরও বলেন, ব্লাডব্যাংকে সাধারণ ফ্রিজে রক্ত সংরক্ষণ করা ও দূষিত ব্লাড বিশুদ্ধ ব্লাডের সঙ্গে রাখা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু তদারকির অভাবে এসব ব্লাডব্যাংক নির্বিঘেœ এ ধরনের অপরাধ করে চলেছে।
সরকারের তদারকি নেই : ব্লাডব্যাংকের লাইসেন্স দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাদের নিয়ন্ত্রণে নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থা তদারকি করতে একটি জাতীয় কমিটিও রয়েছে। এই কমিটি থেকেই বিষয়গুলো তদারকি করার কথা। কিন্তু তাদের পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় এই খাতে তদারকি হচ্ছে না। র্যাব মাঝে মধ্যে বিচ্ছিন্ন অভিযান চালায়। শ্যামলীর বাংলাদেশ ব্লাডব্যাংক অ্যান্ড ট্রান্সফিউশনের কর্মকর্তা সুমন হাসান বলেন, এখানে কোনো সরকারি কর্মকর্তা পরিদর্শনে আসেন না। এই ব্লাডব্যাংকে রক্ত সংগ্রহের জন্য যথেষ্ট কর্মীও নেই।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন কেন্দ্রের কর্মকর্তা নজিব আহমেদ বলেন, নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন নিশ্চিত করতে সরকারের তদারকি বাড়াতে হবে। যারা রক্ত নিয়ে ব্যবসা করছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে মানুষকে সচেতন করতে হবে, যাতে তারা পেশাদার রক্তদাতাদের রক্ত গ্রহণ না করে।
পেশাদার রক্তদাতারাই রোগে আক্রান্ত : নিয়ম অনুযায়ী কোনো ব্লাডব্যাংকের পেশাদার দাতাদের কাছ থেকে রক্ত নেওয়ার সুযোগ নেই। তাদের কাছে দাতার তালিকা থাকতে হবে, যারা নিয়ম অনুযায়ী স্বেচ্ছায় রক্ত দেবে। কিন্তু অবৈধ ব্লাডব্যাংকগুলোয় এসব তালিকা নেই। তারা কিছু পোশাদার রক্তাদাতা সংগ্রহ করে। তাদের কাছ থেকে চাহিদা অনুযায়ী রক্ত সংগ্রহ করে বিক্রি করে। নিয়ম অনুযায়ী একজন দাতা প্রতি ৩ থেকে ৪ মাস পর একবার রক্ত দিতে পারে। কিন্তু পেশাদার রক্তদাতারা চাহিদা অনুযায়ীই রক্তের জোগান দিয়ে থাকে। ফলে তাদের রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম থাকে। পেশাদার রক্তদাতাদের বেশিরভাগই মাদকাসক্ত, যৌনকর্মী। তাদের রক্ত সংগ্রহ ও সরবরাহের সময় প্রয়োজনীয় পরীক্ষাগুলো করা হয় না।
দালালদের দৌরাত্ম্য : বড় হাসপাতালগুলোর জরুরি বিভাগ বা অন্যান্য বিভাগে থাকে দালাল চক্রের আস্তানা। তারা আগে থেকেই জেনে যায় কার কী অপারেশন বা জরুরি প্রয়োজনে রক্ত লাগবে। সে অনুযায়ী দালালরা রোগীর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে রক্তের জোগান দেয়। প্রতি ব্যাগ রক্তের জন্য ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা নেওয়া হয়। কখনো আরও বেশি।
এ বিষয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সন্ধানীর সাধারণ সম্পাদক সৌরভ সরকার বলেন, দালালদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হলে সচেতনতা দরকার। একই সঙ্গে দরকার রক্ত দেওয়ার মানসিকতা। কিন্তু এটি আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি। ফলে চাহিদা অনুযায়ী রক্ত পাওয়া যাচ্ছে না। রক্তের অভাবে অনেক প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। অথচ রক্ত আমাদের দেহে চার মাস পর-পর নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন রক্তকণিকার। দৈনিক আমাদের সময়