ওয়াজের সেকাল আর ওয়াজের একাল - সময়ের সংলাপ24
DHAKA WEATHER

Post Bottom Ad

demo-image

ওয়াজের সেকাল আর ওয়াজের একাল

Share This
খুব শীগ্রই আমরা Somoyersonglap24.com ওয়েবসাইট নিয়ে আসছি..
বহু বছর আগেকার ঘটনা। নানুপুরের মরহুম পীর মাওলানা সুলতান আহমদ (রহ.) একবার উত্তরবঙ্গে টানা তিন দিন মাহফিল করেন। ঘটনাক্রমে সেবার কোনো মাহফিল কর্তৃপক্ষই তাকে হাদিয়া দেয়নি। সব মাহফিলের আয়োজকদের ধারণা ছিল, পরবর্তী মাহফিলে তো হুজুর হাদিয়া পাবেনই, বা পূর্ববর্তী মাহফিলে পেয়েছেন। তাই আমরা না দিলে আর কী আসে যায়?

তিন দিনের ধারাবাহিক মাহফিল শেষে কোনো হাদিয়া না পেয়েও হজরতের চেহারার ভাব ছিল সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। আক্ষেপের লেশমাত্র ছিল না।

এদিকে হুজুরের পকেটে সামান্য যা টাকা ছিল, তা দিয়ে দু’জনে ট্রেনের টিকিট নিয়ে ফেনী পর্যন্ত আসার ভাড়া হয়েছিল। ফেনী রেলস্টেশনে নেমে হজরত তার এক মুরিদ সুলতান হাজীর বাড়িতে উঠলেন। তার কাছ থেকে ফেনী থেকে নানুপুর (নাজিরহাট, চট্টগ্রাম) যাওয়ার পরিমাণ দুজনের ভাড়া ধার নিলেন। নানুপুর পৌঁছে ঘরে গিয়ে স্ত্রীর কাছ থেকে ২ সের চাল চেয়ে নিলেন।

হজরতের বিবিজান বললেন, চাল কেন? তিনি বললেন, বিক্রি করে বাজার করতে হবে। বিবিজান বললেন, আপনি না মাহফিল করে এলেন! ওরা টাকা দেয়নি?

হজরতের জবাব ছিল, ‘আঁই কি টাকা কামাইতাম গেয়ি না? আঁই ত মানুষেরে ওয়াজ-নসিহত শুনাইতাম গেয়ি!’ (আমি কি টাকা কামাতে গিয়েছি? আমি তো মানুষকে নসিহত শুনাতে গিয়েছি)। অতঃপর দু’সের চাল নিয়ে নানুপুর বাজারে গেলেন এবং বিক্রি করে ঘরের জন্য বাজার করে আনলেন।

নানুপুরের মরহুম পীর সাহেবের তখনকার সফরসঙ্গী ও প্রিয় খলিফা, ফেনী লালপুর সুলতানিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মুফতি সাঈদ আহমদ (রহ.) নিজ মুখে এ ঘটনা শোনাতেন।

একটি সময় এমনই ছিল ওয়াজ মাহফিলের অবস্থা। ইসলামের ইতিহাসে ওয়াজের মাধ্যমেই দাওয়াতের কাজের গতি পেয়েছে। ইসলামের এ তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়টি ভারতীয় উপমহাদেশে ঐতিহ্য লাভ করেছে। উপমহাদেশের যেখানেই মুসলমান আছে, সেখানেই ওয়াজের সুর ফুটেছে।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ওয়াজ মাহফিল নিয়ে আমাদের সমাজে নানা প্রবণতা শুরু হয়েছে, যা অনেক সময় ইসলামের মৌলিক আদর্শকেও ক্ষুণ্ণ করছে। এখন মহল্লায় মহল্লায় প্রতি রাতে মাহফিল হচ্ছে; কিন্তু কেন যেন মানুষের ভেতর জগতে পরিবর্তন আসছে না। মাহফিল শুনতে শুনতে জীবন-যৌবন শেষ হয়ে যাওয়া মানুষটিও মরণ ভুলে, আল্লাহ-রাসূল ভুলে পাপের সাগরে ডুবে থাকছে।

গবেষক আলেম ও চট্টগ্রাম ওমর গণি কলেজের ইতিহাসের সাবেক অধ্যাপক ড. আ ফ ম খালিদ হুসাইন বলেন, ওয়াজ বা নসিহত তাবলিগের অংশ। যুগে যুগে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার জন্য ওয়াজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ওয়াজের বিনিময় নেয়ার প্রচলন সাহাবা ও পূর্ববর্তীদের যুগে ছিল না। পরবর্তী সময়ে কেউ শুধু পথ খরচ বা সামান্য হাদিয়া নিতেন। আবার অনেকে কোনো হাদিয়াই নিতেন না।

কিন্তু সাম্প্রতিককালে ওয়াজ অনেকটা ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। আলোচক-ওয়ায়েজ সবাই ধর্মীয় এ বিষয়টিকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি বা উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছেন।

বর্তমানে ওয়াজ মাহফিলের রূপান্তর ঘটেছে মন্তব্য করে চিন্তাবিদ এ আলেম বলেন, ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ওয়াজ শুনতে ভালোবাসেন, ওয়াজের কথা শুনলেই অনেক মানুষ দূর-দূরান্তে ছুটে যান। তবে কিছু আলেম নামধারী ব্যক্তিদের জন্য তাদের সম্মান ও মর্যাদাহানি হচ্ছে। তাদের হাস্যকর ওয়াজের কারণে ইসলামের সৌন্দর্য ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। সুরের মূর্ছনা ও কৌতুকের মতো বয়ানের মাধ্যমে তারা এর আধ্যাত্মিক বিষয়টি নষ্ট করছেন।

এ বিষয়ে মিরপুর আকবর কমপ্লেক্সের প্রিন্সিপাল বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন মুফতি দেলওয়ার হুসাইন বলেন, ওয়াজ হল একটি ধর্মীয় বিষয়। মানুষের ধর্মীয় ও নৈতিক উন্নতি হল ওয়াজের মূল বিষয়। এটিকে কৌতুক বা বিনোদন বানানো যাবে না। তাই এ ক্ষেত্রে বক্তাদের অনেক বিষয় লক্ষ রাখতে হবে।

ওয়াজের বিষয় ও ভাষা কেমন হওয়া উচিত এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্বাবলীল ও সহজ ভাষায় মানুষের সামনে ধর্মীয় বিষয়গুলো উপস্থাপন করতে হবে। ফেতনা বা বিতর্ক সৃষ্টি হয়, সাধারণ মানুষের বোধগম্য নয় এমন বিষয়ে বয়ান করা যাবে না। আলোচনা হতে হবে কোরআন হাদিসনির্ভর। গাল-গল্প বা অহেতুক বিষয় ওয়াজ মাহফিলের আবেদন নষ্ট করে দেয়।

যেসব বক্তা অহেতুক বিষয় বা বিরক্তকর বিষয়ে বয়ান করেন তাদের ব্যাপারে করণীয় কী জানতে চাইলে মুফতি দেলওয়ার বলেন, আসলে ওয়াজের ময়দানে কারও একক নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই এমন বক্তাদের থামানো যাচ্ছে না। দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে মাহফিলের আয়োজকদের সচেতন হওয়া দরকার। ভালোমানের আলেমদেরই দেয়া উচিত। তাহলে এসব বক্তার কদর কমে যাবে।

সুবক্তা ও মিডিয়াব্যক্তিত্ব মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদীর মতে, অনেক তরুণ আলেম এখন ভাইরাল হওয়ার জন্য ওয়াজে এমন বিষয়ে আলোচনা করেন, যেসব বিষয় সবার জন্যই বিব্রতকর। তরুণ বক্তারা যদি কাউকে নকল না করে আরও গবেষণায় মনোযোগী হয় তাহলে মানুষ তাদের থেকে ভালো কিছু পেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

মাওলানা আজাদীর মতে, ওয়াজের পরিবর্তন যে শুধু বক্তা ও আয়োজকদের মধ্যে এসেছে এমন নয়। শ্রোতারাও এখন বিষয়টিকে বিনোদন হিসেবে নিয়েছে। একজন আলেম যদি শুধু কোরআন থেকে তাফসির করেন, শ্রোতারা তা ততটা শোনে না। যতটা অন্য বক্তার গাল-গপ্প শোনে। এজন্য সামগ্রিকভাবে সবার মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। আলোচক-আয়োজক ও শ্রোতা সবার মনেই হেদায়াতের প্রত্যাশা থাকতে হবে। তবেই ওয়াজ মাহফিলগুলো আগের সেই প্রাণ ফিরে পাবে।

ইদানীং বিভিন্ন বক্তার বয়ানে গালাগালি, ধমকাধমকি, মিথ্যা, ঠাটবাট এবং অন্যকে অপমান করা, ছোট বানানোর নানা কথাবার্তা দিয়ে সাজানো থাকে; যা সাধারণ মানুষের মনে গভীর প্রভাব ফেলে।

এ বিষয়ে সেলিম হোসাইন আজাদী বলেন, আলেমদের মধ্যে কোনো বিষয়ে মতবিরোধ থাকলে তা সমাধানের জন্য আলোচনার টেবিল রয়েছে। সাধারণ মানুষের সামনে ভিন্ন মতাবলম্বীদের হেয় করা কোনোভাবেই ঠিক নয়। মানুষ মনে করে, এসবই বুঝি ওয়াজ। তখন মানুষও এ ঘৃণ্যতায় ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক ছড়িয়ে দেয়।

ড. আ ফ ম খালিদের মতে, সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে যেহেতু এখন সব বিষয়ই সবার সামনে চলে আসছে, এ জন্য বক্তাদের নির্দিষ্ট কিছু সীমারেখা মেনে চলা উচিত। ওয়াজের দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য সিনিয়র আলেমদের তত্ত্বাবধানে একটি জাতীয় সমন্বয় কমিটিরও প্রস্তাব করেন তিনি।

চিন্তাশীল এ আলেমের কাছে প্রশ্ন করেছিলাম ওয়াজের মাধ্যমে বক্তারা ভালো অর্থ উপার্জন করেন, এসব টাকার আয়কর দেয়া হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, ওয়াজের টাকা করের আওতায় আসবে কিনা, এটি আইনি বিষয়। সরকারিভাবে যেহেতু এ বিষয়ে কোনো নির্দশনা নেই, তাই শুধু ওয়াজের টাকার আয়কর অনেকে দেননা। তবে রাষ্ট্রীয় আইনে কোনো আলেমের সম্পদ যদি করের আওতায় পড়ে তাহলে তার তা দেয়া উচিত।

এ বছর আয়কর রিটার্ন উপার্জনের খাতে ওয়াজের হাদিয়া অন্তর্ভুক্ত করেছেন বলে জানান তিনি।

ওয়াজ হল মানুষকে দ্বীনের প্রতি আহ্বান। হৃদয় নিংড়ানো কথা ও উপদেশপূর্ণ বাণীর মাধ্যমে ইসলামের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলার মাধ্যম। তাই দুনিয়ার সব ধরনের লাভ ও লোভের মোহমুক্ত হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে মানুষকে ওয়াজ শোনাতে হবে। কাজেকর্মে কথাবার্তায় কোনোভাবেই যেন এর ব্যতিক্রম না হয়, বিষয়টি বক্তাদের লক্ষ রাখতে হবে।

মাওলানা আজাদীর ভাষায়, ওয়াজের মাধ্যমে আল্লাহভোলা বান্দাদের হৃদয়ের খোরাক দিতে হবে। আফসোস! আজ বাড়ি বাড়ি, মহল্লায়-মহল্লায় প্রতি রাতে মাহফিল হচ্ছে; কিন্তু মানুষর হৃদয়ে জগতে পরিবর্তন আসছে না। ওয়াজ আজ প্রেমহীন বাক্যালাপে পরিণত হয়েছে!
লেখক : তরুণ আলেম ও সহ-সম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর

-সময়ের সংলাপ২৪/ডি-এইচ
Comment Using!!

Pages