গত শনিবার (১৮ এপ্রিল) করোনাভাইরাসে সারা দেশে মারা গেছেন ৭ জন। অথচ একইদিনে বজ্রপাতে কেবল হাওর এলাকায়ই মারা গেছেন ১১ জন। মৃতদের বেশিরভাগই কৃষক। ধান কাটতে গিয়েই বজ্রপাতে মারা যান তারা।
ফলে হাওরজুড়ে এখন বজ্রপাত আতঙ্ক। কিন্তু এই আতঙ্কে ঘরে বসে থাকার জো নেই কৃষকদের। কারণ ১৬ এপ্রিল থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে সিলেটে। বৃষ্টি আরও কিছুদিন অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এদিকে, বৃষ্টি হচ্ছে সিলেটের সীমান্ত লাগোয়া ভারতের পাহাড়ি এলাকায়ও। সেখানে বৃষ্টির ফলে পাহাড়ি ঢল নেমে হাওরাঞ্চলে বন্যা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই বজ্রপাতের ভয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বন্যার ভয়ও। কিন্তু দ্রুত ফসল কাটারও তো সুযোগ নেই হাওরে। করোনাভাইরাসে কারণে হাওরে ধানা কাটার শ্রমিকদের অভাব এখনও ঘুচেনি। বন্যা, বজ্রপাত আর করোনা এই তিন উপদ্রব মিলে ফসল হারানোর শঙ্কায় ভুগছেন হাওরের কৃষকরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সোমবার পর্যন্ত সিলেট বিভাগে ধান কাটা হয়েছে ১৮ শতাংশ। এরমধ্যে হাওর এলাকায় কাটা হয়েছে ২২ শতাংশ। অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকায় কিছুটা কম কাটা হয়েছে।
দেশের সবচেয়ে হাওরবেষ্ঠিত জেলা সুনামগঞ্জ। এ জেলায় এখন পর্যন্ত ১৪ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের উপপরিচালক সফর উদ্দিন।
মূলত ১৪ এপ্রিল থেকেই হাওরাঞ্চলে ধান কাটা শুরু হয়। আর ১৬ এপ্রিল থেকেই শুরু হয় প্রবল বৃষ্টি আর বজ্রপাত। শনিবার একদিনেই বজ্রপাতে হাওর এলাকায় মারা গেছেন ১১ জন। এরমধ্যে সিলেট সদর উপজেলায় ২ জন, জকিগঞ্জে ১জন, ওসমানীনগরে ১ জন, সুনামগঞ্জের শাল্লা, জগন্নাথপুর, দিরাই ও দক্ষিণ সুনামগঞ্জে একজন করে ৪ জন, সিলেট সদর উপজেলায় ২ জন, জকিগঞ্জে ১ জন, ওসমানীনগরে ১ জন, সুনামগঞ্জে শাল্লা, জগন্নাথপুর, দিরাই ও দক্ষিণ সুনামগঞ্জে একজন করে ৪ জন, হবিগঞ্জের মাধবপুরে ১ জন এবং নেত্রকোনার মদনে দুজন মারা যান। নিহত মধ্যে ৯ জনই কৃষক। হাওরে ধান কাটার সময় ব্রজপাতে মারা যান তারা।
তবে বজ্রপাত আতঙ্কেও বসে নেই হাওরের কৃষকরা। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওর, মাটিয়ান হাওর, দেখার হাওর, সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার নান্দাইল হাওর, মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার হাকালুকি হাওরসহ বিভাগের কয়েকটি হাওরে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, কৃষকরা ব্যস্ত ধান কাটায়। তাড়াতাড়ি ধান তুলতে পরিবারের নারী সদস্যরাও যোগ দিয়েছেন ধান কাটায়। হাওরে-হাওরে ভয় তাড়ানিয়া গান গেয়ে ধান কেটে চলছেন কৃষকরা। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও দ্রুত ধান কাটতে হাওর এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছে।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার কৃষক সুরুজ মিয়া বলেন, হাওরে গেলে বজ্রপাতের ভয় আবার ঘরে ঘরে বসে থাকলে বন্যায় ফসল তলিয়ে যাওয়ার ভয়। সেইসাথে আছে করোনায় ভয়। তাই আমরা এখন পড়েছি ত্রিমুখী সঙ্কটে। কিন্তু ঘরে বসে তো ফসল তলিয়ে যাওয়া দেখতে পারি না। তাই ভয় উপেক্ষা করেই ধান কাটতে নেমেছি।
তিনি বলেন, বাইরে থেকে এবার কোনো শ্রমিক আসেনি। ধান কাটার যন্ত্রও পাইনি। তাই নিজের আত্মীয়-স্বজন নিয়ে ধান কাটতে নামছি।
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কৃষক সমিরন দাশ বলেন, প্রথমদিকে বৃষ্টির অভাবে কিছুৃ ধান নষ্ট হয়েছে। তবে এবার ফসল মোটামুটি ভালো হয়েছে। তিনি বলেন, বজ্রপাতের ভয়ে ঘরে বসে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে। এরচেয়ে মাঠে গিয়েই মরা ভালো। তাই ধান কাটতে এসেছি।
এদিকে, আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে সিলেটে বৃষ্টি আরও কয়েকদিন অব্যাহত থাকবে।
বৃষ্টি হচ্ছে সিলেটের সীমান্ত লাগোয়া ভারতের পাহাড়ি রাজ্যগুলোতে। ২৩ মে থেকে এসব রাজ্যে বৃষ্টি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে জানিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভুইয়া বলেন, এতে চলতি সপ্তাহের শেষের দিকে পাহাড়ি ঢল নেমে সিলেট বিভাগের নিচু এলাকায় আগাম বন্যা দেখা দিতে পারে। ঢলে সুরমা, কুশিয়ারা ও মনু নদী উপচে পানি হাওরে প্রবেশ করতে পারে বলে জানান তিনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক নিবাস দেবনাথ বলেন, শ্রমিক সঙ্কট দূর করতে বিভিন্ন জেলা থেকে শ্রমিক আনা হয়েছে। আমরা আশা করছি ৩০ এপ্রিলের মধ্যে ধান কাটা সম্পন্ন হবে।
প্রসঙ্গত, এবার সিলেট বিভাগের ৪ জেলায় ৪ লক্ষ ৭৩ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে।
-সময়ের সংলাপ২৪/ডি-এইচ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন