দুই দশক আগে গ্রামের বাড়িতে টিভি ছিল না। টিভি দেখতাম পাশের বাড়িতে। সেখানে এক আঙ্কেল ছিলেন ব্যাংকের ম্যানেজার। তিনি পাকিস্তান ভক্ত। ৯৯ বিশ্বকাপের খেলা দেখছি তার সঙ্গে বসে। তার একটা কথা এখনো কানে লেগে আছে। পাকিস্তান ভক্ত হলেও তার দৃষ্টিতে সেবারের সেরা ক্যাপ্টেন ছিলেন হ্যানসি ক্রনিয়ে। আমাকে দেখিয়ে বলতেন- ‘এই লোকটা হলো একটা বাঘ’! ওয়াসিম আকরামকেও তিনি ‘বাঘ’ বলতেন। তবে সেরা ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার সেই লড়াকু ক্যাপ্টেন ‘ক্রনিয়ে’। বিমান দুর্ঘটনায় শেষ হয় তার জীবন। সেমিফাইনালে ল্যান্স ক্লুজনার রান আউট না হলে কে জানে, হয়ত ৯৯ বিশ্বকাপটা উঠত সেই আহত বাঘের হাতেই।
গল্পটা বলার উদ্দেশ্য হলো, ক্রিকেট মাঠে ক্যাপ্টেনের দাপুটে উপস্থিতি দলের জন্য কতটা বাড়তি শক্তি, বাড়তি প্রেরণা হতে পারে এবং দর্শক কতটা উপভোগ করেন তা বোঝানোর জন্য। এক সময়ে ইমরান খান, কপিল দেব, স্টিভ ওয়াহ, ওয়াসিম আকরাম, হ্যান্সি ক্রনিয়ে, রানাতুঙ্গা, সৌরভ গাঙ্গুলিরা ছিলেন মাঠের প্রতিপক্ষের জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক। দলের অবস্থা যাই হোক, ক্যাপ্টেনের ওপর থেকে ভরসা কেউ হারাতেন না। তারা যেন যাদুর কাঠি নিয়েই মাঠে নামতেন। তাদের হাত থেকে কী চাল বেরোয়- তা নিয়ে রীতিমত শঙ্কায় থাকতে হতো প্রতিপক্ষ ক্যাপ্টেনদের!
সম্প্রতি সাবেক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন রমিজ রাজা যখন আমাদের মাশরাফিকে ‘কাপ্তান অব এশিয়া’ উপাধি দেন, তখন আমার পাশের বাড়ির আঙ্কেলের কথা মনে পড়ে যায়। মনে মনে আমি বলি- মাশরাফি তো সত্যিকারের বাঘ! এশিয়ার কেন, সে হবে ‘কাপ্তান অব ওয়ার্ল্ড’! সেই আঙ্কেল হয়ত মাশরাফিকে বলবেন, বাঘেদের সেরা বাঘ! এমনিতে বাংলাদেশের মানুষ তাকে ‘জনতার ক্যাপ্টেন’ বলে। সবার প্রত্যাশা- উনিশের বিশ্বকাপ জিতে জনতার এই ক্যাপ্টেন নিজেকে নিয়ে যাবেন জগতের সব ক্যাপ্টেনের ঊর্ধ্বে। হাঁটুতে সাতটা অপারেশনের পরেও কে কবে বিশ্বসেরা দলের নেতা হতে পেরেছে? সাধারণের এই স্বপ্নকে মাশরাফি যদিও কখনো প্রশ্রয় দেন না, তিনি বলেন ‘শিরোপা না জিতলেও দুঃখ থাকবে না’, তথাপি জাতি কি তা বুঝতে চাইবে? জাতি তো মাশরাফির হাতে শিরোপা দেখতে চায়। নিদেনপক্ষে বিশ্বকাপের মাঠে প্রতিপক্ষের বুকে কাঁপন ধরাবেন ক্যাপ্টেন মাশরাফি- এটা চায় জাতি। কিন্তু সবকিছুতে যেন একটু গড়বড় হয়ে গেল। মানুষের প্রত্যাশা-স্বপ্ন আর মাশরাফির ‘ভিশন’ যেন সমান তালে হাঁটছে না। জনতার ক্যাপ্টেনের আর্মব্যান্ড খুলে রেখে তিনি হতে চান জনতার নেতা! ভালো নেতার অভাবে ভুগতে থাকা জাতি মাশরাফিকে নেতা হিসেবে পেলে খুশিই হওয়ার কথা। কিন্ত উল্টো বাঁধল গোল। আলোচনা-সমালোচনার চেয়েও বেশি হলো নিন্দা-টিপ্পনি! মাশরাফির মুখে লেগে গেল তালা। কেন? একদিনেই মাশরাফি হিরো থেকে জিরো হয়ে গেল?
যে মাশরাফি ডাক্তারের ছুরির নিচে গেলেন একবার নায়, দুবার নয় বহুবার; যার হাঁটুতে জমে থাকা পানি সুঁচ দিয়ে টেনে বের করার পর তিনি মাঠে নামেন; যার বাকি জীবনটাই আছে পঙ্গুত্বের হুমকির মুখে, যিনি অন্ধকারে আলো দেন, যিনি বিপদের মুখে দলের হাল ধরেন, যিনি পরাজয়ে পরাজয়ে ক্লান্ত দলকে জয়ের বন্দরে ফেরানো শেখান, যিনি ১৬ কোটি মানুষের মুখে হাসি ফোটান, যিনি বলেন ‘আমি কিছুই না- এদেশে সম্মান পাওয়ার স্যা্লুট পাওয়ার আরো অনেক লোক আছে’-তাকে এক নিমিষেই এভাবে কটূক্তি ছুড়তে এতটুকু বাধল না আমাদের? এখন তো বড় প্রশ্ন হয়- জাতি হিসেবে আমরা আসলে কতটা পরিণত এবং কতটা পাওয়ার অধিকার রাখি? আমরা কি বিশ্বসেরা হওয়ার যোগ্যতা রাখি? যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি সেরা হওয়ার, যে এত এত প্রাপ্তি এনে দিল আমাদের, তার কোনো কথা না শুনে, তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা না শুনে, তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কেবল একটি মনোনয়ন ফরম কেনার অপরাধে যেভাবে নিন্দার ঝড় ওঠানো হলো, কোনো সভ্য সমাজ এটি করতে পারে? মাশরাফির ভক্তদের কাছেই এই প্রশ্নটি রাখতে চাই।
নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য একটি দলের মনোনয়ন চাওয়া মোটেই বড় কোনো অপরাধ নয়। আসলে এটি কোনো অপরাধই নয়। মাশরাফি একজন জাত লিডার। তিনি খেলার মাঠে যেমন, তেমনি মাঠের বাইরেও সমভাবে নেতা হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। নেতা হওয়ার বড় গুণ হলো মানুষকে ভালোবাসা। মাশরাফির মধ্যে এই গুণ বর্তমান বাংলাদেশে অন্য অনেকের চেয়ে বেশি আছে। এমনকি সুস্থ চিন্তা যারা করেন, তাদের মতে মাশরাফি বাংলাদেশের আর দশজন নেতার মতো টাকা বানানোর লোভে রাজনীতিতে পা বাড়াচ্ছেন না। ক্রিকেট খেলে মাশরাফির কম টাকা হয়নি। বাকি জীবন কিছু না করলেও তিনি ভালোভাবেই চলতে পারবেন। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকবে না, তাই জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগানোই মাশরাফির ইচ্ছা। নড়াইল এক্সপ্রেস ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে নিজের মানবিক সত্তার পরিচয় এরইমধ্যে মাশরাফি রেখেছেন। মাশরাফিকে জানতে হলে তার ইচ্ছা ও স্বপ্ন জানতে হলে, তার বিষয়ে করা বিভিন্ন সময়ের প্রতিবেদন পড়তে হবে, তার ওপর লেখা বই পড়তে হবে।
একজন ভালো রাজনৈতিক নেতা হতে চাওয়ার বিষয়টি মাশরাফির সাথেই বেশি করে যায়। অন্তত বাংলাদেশের সংসদে একজন মানুষকে আমরা দেখার আশা করতে পারি যিনি সত্যিকার অর্থে দেশপ্রেমিক এবং যিনি সত্যিকার অর্থে মানুষের কল্যাণ চান। রাজনীতিতে গেলে মাশরাফি কতটা ভালো থাকবেন, সৎ থাকবেন- এই প্রশ্ন না করে বরং আমাদের মধ্যে প্রশ্ন থাকা উচিত- নীতিহীনদের ভিড়ে এবং তাদের অন্যায় চাপে মাশরাফি ক’দিন সেখানে থাকতে পারবেন? সুতরাং মাশরাফি কেন সংসদ নির্বাচনে লড়তে নামছেন- এই প্রশ্ন তোলা নিতান্তই অবান্তর। তিনি এখন জনতার ক্যাপ্টেন আছেন, চাইলে জনতার নেতাও তিনি হতে পারেন। তবে হ্যাঁ, এই প্রশ্নটি তোলা যায়- বিশ্বকাপের আগে এবং অবসর না নিয়ে তার রাজনৈতিক সদিচ্ছা পূরণের মিশনে নামাটা কতটা যৌক্তিক হয়েছে? মাশরাফিকে যারা ভালোবাসেন, যারা এই ঝড়ের মধ্যেও তার পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন- এমন অনেকের মনেই এই প্রশ্ন আছে। এবং মাশরাফির মতো জনপ্রিয় ব্যক্তিদের কাছে সাধারণ মানুষের এইসব ভালোবাসাজনিত আবেগের মূল্যায়ন থাকা উচিত। ডিসেম্বর মাসে ভোটের হাওয়া যখন অনেক বেশি গরম থাকবে ঠিক তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ঘরের মাঠের সিরিজে মাশরাফি মাঠের লড়াইয়ে থাকবেন নাকি ভোটের ময়দানে থাকবেন তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এর প্রীতিকর একটা জবাব মাশরাফিকেই দিতে হবে। যদিও ক্রিকেট বোর্ড প্রধান এরই মধ্যে ‘ভজঘট’ পাকিয়ে ফেলেছেন। তিনি বলেছেন ‘মাশরাফি তো শুধু ক্যাপ্টেন হিসেবে খেলে’! অর্থাৎ মাশরাফি এখন আর ঠিক খেলোয়াড় হিসেবে দলে সুযোগ পান না! সুতরাং তিনি না থাকলেও চলবে! কী করে, কোন সাহসে ম্যাশকে নিয়ে তিনি এমনটা বলতে পারেন? তাহলে কি ম্যাশকে নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র হচ্ছে?
আওয়ামী লীগের ধানমণ্ডি অফিসে যেদিন মাশরাফি মনোনয়ন আনতে গেলেন, আমরা তার ঠোঁটে একচিলতে হাসিও দেখিনি, চোখে-মুখে দেখিনি কোনো উচ্ছ্বাস। ভোটের মতো একটি উৎসবের সূচনাকর্মে ম্যাশের অমন নীরব চাহনি আর উচ্ছ্বাসহীন পদচারণা তাকে নিয়ে চিন্তাশীল ভক্তদের চিন্তা আরও বাড়িয়েছে। মাশরাফি কি কোনো চাপে আছেন? এর আগে অনেকবারই নড়াইলের রাস্তায় মাশরাফির নামে স্লোগান হয়েছে। সেসব মিছিলে মাশরাফিকেও দেখা গেছে স্বতঃস্ফূর্ত। কিন্তু মনোনয়ন ফরম কেনার পর মাশরাফির নামে হওয়া মিছিলের ভাষা যেমন পরিবর্তিত হয়েছে তেমনি মিছিলের মানুষজনের চেহারায়ও কিঞ্চিত পরিবর্তন এসেছে। ভালোবাসায় খামতি পড়েছে অনেকের। এখন পর্যন্ত মিছিলের অগ্রভাগে দেখা যায়নি মাশরাফিকেও। নিজের প্রাপ্য উপহারের বিনিময়ে নড়াইলবাসীকে এ্যাম্বুলেন্স কিনে দেওয়া মাশরাফির ভাগ্য আসলে এখনো নড়াইলবাসীর কাছেই পরিষ্কার নয়। এখনো ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়’ ধরনের একটা ‘ঢাক ঢাক গুড় গুড়’ ভাব চারদিকে।
রাজনীতির ঘরে ঘটনা যাই ঘটুক, ক্রিকেটের ঘরে মাশরাফির পদচারণা আরও কিছুদিন চলুক- এই মুহূর্তে জাতির বড় চাওয়া এটিই। আমাদের ক্রিকেটের ‘এই ঘর এই সংসার’ যেন রাজনীতির ঝড়ো বাতাসে ভেঙে না যায়। উনিশের বিশ্বকাপে আমরা যেন নড়াইল এক্সপ্রেসের নেতৃত্বে টগবগে টাইগার দল নিয়ে তছনছ করে দিতে পারি একের পর এক প্রতিপক্ষকে। রমিজ রাজারা যেন আরেকবার বলতে পারেন ‘কাপ্তান অব এশিয়া কাপ নাউ কাপ্তান অব ওয়ার্ল্ড কাপ’।
মাশারাফি মাশরাফিই। তাকে যেন আমরা ভুলে না যাই; ক্রিকেট মাঠে তার অবদান যেন ভুলে না যাই এক নিমেষে। লাল-সবুজের জার্সি গায়ে মাশরাফি আমাদের যা দিয়েছেন, এক জীবনে আর কে কতটা দিয়েছে? আমাদের কত হাসি-কান্নার নায়ক মাশরাফি- একবার চিন্তা করে দেখুন? দয়া করে তাকে কটূ কথা বলবেন না। তার জন্য দোয়া করুন; শুভ কামনা জানান। কে জানে, হয়ত মাশরাফি ক্রিকেট মাঠের চেয়েও আমাদের ভালো কিছু দিতে পারেন রাজনীতির মাঠে। এমনও তো হতে পারে, রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করার সূচনা হলো ম্যাশের হাত ধরেই! আমরা কে এটা চাই না? ভালো প্রত্যাশা থাকতে তো দোষ নেই। আসুন আমরা ম্যাশের সঙ্গে থাকি, আমাদের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে থাকি। অনেক অনেক শুভ কামনা প্রিয় ম্যাশ।
-সময়ের সংলাপ২৪/ডি-এইচ