চলতি মার্চ মাসের ১৪ তারিখের ঘটনা। চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার দক্ষিণ ভুর্ষি ইউনিয়নের পূর্ব ডেঙ্গাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মিসফা সুলতানা অন্যান্য দিনের মতো ক্লাসে পড়াচ্ছিলেন। হঠাৎ সকাল সোয়া নয়টার দিকে ক্লাসে ঢুকে পড়ে এক যুবক। হাতে লোহার শাবল। সে সেই শাবল দিয়ে পেটানো শুরু করে মিসফা সুলতানাকে। আত্মরক্ষার জন্য মিসফা দৌড়ে স্কুলের মাঠে যান। যুবকটি সেখানে গিয়েও তাঁকে পেটাতে থাকে। পরে স্কুলের অন্যান্য শিক্ষক ও আশপাশের লোকজন এগিয়ে এসে মিসফাকে উদ্ধার করেন। কিন্তু ততক্ষণে মিসফার দুই হাত ভেঙে গেছে। একটি পা গুরুতর জখম হয়েছে।
১৫ মার্চ প্রথম আলোসহ দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোয় খবরটি ছাপা হয়। এতে বলা হয়, আহসান উল্লাহ টুটুল নামে ওই বখাটে বেশ কয়েক দিন ধরে মিসফাকে উত্ত্যক্ত করছিল। কিন্তু মিসফা তাকে কোনো পাত্তা দেননি। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে আহসান; তার জের ধরে এই হামলা। খবরটি পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, ওই বখাটে কোথা থেকে এত সাহস পেল? পছন্দের মেয়েটি পাত্তা দিল না বলে একেবারে স্কুলের ভেতরে ঢুকে তার ওপরে হামলা? বখাটে বলে কি যা খুশি তা করার লাইসেন্স সে পেয়ে গেছে?
পত্রিকার পাতায় বখাটেদের যেসব কর্মকাণ্ডের খবর বেরোয় তাতে মনে হয় আসলে যা খুশি তাই করার অধিকার বখাটেদের আছে। এখানে কয়েকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করছি। কুড়িগ্রামের রৌমারীর এক গৃহবধূর প্রেমে পড়েছিলেন রিপন মিয়া (২২) নামে এক বখাটে। গৃহবধূর সঙ্গে প্রেম করার জন্য তিনি নানা কৌশল অবলম্বন করেন। কিন্তু তাঁর সব কৌশল ব্যর্থ হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন রিপন। একদিন সুযোগ বুঝে ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন গৃহবধূটির ওপর। উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে ক্ষতবিক্ষত করেন গৃহবধূর দেহ। ঘটনাটি ঘটেছে গত বছরের জানুয়ারি মাসে।
২০১৫ সালের ঘটনা। পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলায় অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করত তিন বখাটে। মেয়েটি এ ব্যাপারে তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের কাছে অভিযোগ করে। এতে বখাটেরা ক্ষিপ্ত হয়ে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে। এরপর মেয়েটির ঘরে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়।
ফরিদপুরে নতুন মডেলের মোটরসাইকেল কিনে না দেওয়ায় ফারদিন হুদা মুগ্ধ (১৭) নামে এক বখাটে তার মা ও বাবাকে আগুনে পুড়িয়ে দেয়। এতে মা বেঁচে গেলেও বাবা আর বাঁচতে পারেননি।
নরসিংদীর বেলাবতে গত মাসে মাদক সেবনে বাধা দেওয়ায় এক মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁর স্ত্রীকে পিটিয়ে আহত করেছে বখাটেরা। চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে গত বছরের মে মাসে চাঁদা চেয়ে না পেয়ে শ্রমিকদের ঘর পুড়িয়ে দেয় বখাটেরা।
এসব ঘটনায় তো একটা বিষয়ই পরিষ্কার হচ্ছে যে বখাটেরা আসলেই যা খুশি তাই করার অধিকার পেয়ে গেছে। বখাটেদের দৌরাত্ম্যের কথা বলে শেষ করা যাবে না। দুনিয়ার সব বখাটের চরিত্র কেমন করে যেন এক রকম। এক অদ্ভুত কারণে তাদের জীবনাচরণে অনেক মিল। তাদের দেহভঙ্গিমা এক রকম। কথা বলে একই ভঙ্গিতে। কোনো এক অলিখিত শর্তে তারা মদ-গাঁজায় আসক্ত হবেই। লেখাপড়ার প্রতি তাদের কোনো মনোযোগ নেই। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা তাদের প্রধান কাজ। তবে শুধু উত্ত্যক্ত করেই ক্ষান্ত হয় না তারা। পছন্দের পাত্রী এমনিতে রাজি হলে ভালো। না হলে তারা তাকে হাসিল করার জন্য যেকোনো পন্থা অবলম্বন করে। আর ব্যর্থ হলে তাকে আঘাত করো, ধর্ষণ করো, নয়তো অ্যাসিড ছুড়ে বা আগুনে পুড়িয়ে দাও। যেন বখাটেদের এটা মৌলিক অধিকার। তারা চাইলেই যেকোনো মেয়ের ওপর হামলা চালিয়ে তার হাত-পা ভেঙে দিতে পারে। মনের মানসীকে না পেলে ফাটিয়ে দাও বাবার বা ভাইয়ের মাথা। অপহরণ করো তার ছোট ভাইবোন, ভাস্তি বা ভাগনেকে। কুচ পরোয়া নেহি।
কিন্তু এত সব করলেও বখাটেদের কোনো শাস্তি হয় না। তারা সমাজে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এলাকার সবাই বখাটেদের ভয়ে তটস্থ থাকে। কেউ তাদের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করে না। কোনো বখাটে যদি কোনো রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকে, তাহলে তো কোনো কথাই নেই। পরিবারেও তাদের আদরের কমতি থাকে না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি, পরিবারের ভালোবাসা আর এগুলোই বখাটেদের সাহস ও শক্তির উৎস।
ছেলেমেয়েদের বখে যাওয়ার কারণ হিসেবে সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা অনেক কথা বলেছেন। তাঁদের কারও কারও মতে, মা–বাবার উদাসীনতার কারণে সন্তান বখে যায়। সন্তানেরা কোথায় যায়, কার সঙ্গে মিশছে, কার সঙ্গে ফোনে কথা বলছে—অনেক মা-বাবা তার খোঁজ রাখেন না। এই সুযোগে সন্তান বখে যাচ্ছে। আবার অনেকের মতে, ধারাবাহিক অবহেলা, শাসনের নামে মানসিক নির্যাতন চালানো, নিজেদের নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকার মধ্য দিয়েই সন্তানদের দূরে ঠেলে দেওয়া হয়। এ ধরনের একাকিত্ব আর হতাশা থেকেই উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা মাদকে জড়িয়ে পড়ে, হয়ে ওঠে বখাটে। সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের মতের সঙ্গে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এখানে আমি আরেকটা কথা বলতে চাই, আর তা হচ্ছে সন্তানের প্রতি মা-বাবার অন্ধ ভালোবাসা তাদের বখাটে হয়ে ওঠার জন্য অনেকাংশে দায়ী। সন্তান শত অন্যায় করলেও মা–বাবা তাদের কিছু বলেন না। সন্তানের সব চাওয়া তঁারা পূরণ করেন। যে ছেলে স্কুলে পড়ে তার জন্য কি দামি মোটরসাইকেল, দামি মোবাইল ফোনের প্রয়োজন আছে? কিন্তু দেখা যাচ্ছে অনেক অভিভাবক তাঁদের সন্তানদের হাতে এসব জিনিস তুলে দিচ্ছেন। পথ প্রশস্ত করে দিচ্ছেন তাদের বখাটে হয়ে ওঠার।
কিন্তু এমনটা কি চলতেই থাকবে? কারও কি কিছু করার নেই? নিশ্চয়ই আছে। প্রথমে প্রত্যেক মা-বাবাকে তাঁদের সন্তান সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। সন্তানকে সঠিক মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে হবে। স্লোগান আছে শিশুদের জন্য ‘হ্যাঁ’ বলুন। কিন্তু কখনো কখনো ‘না’ কথাটাও বলতে হবে। চাওয়ামাত্রই তার হাতে দামি মুঠোফোন তুলে দেওয়া যাবে না। এমন কোনো কাজ তাঁরা করবেন না, যাতে সন্তান বখে যেতে পারে। বখাটে সন্তানের জন্য গর্বিত নয়, লজ্জিত বোধ করুন।
বখাটেদের বখাটেপনা রুখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও তৎপর হতে হবে। ঢাকা মহানগর পুলিশ আইনের ৭৬ ধারা অনুযায়ী বখাটেপনার শাস্তি এক বছরের কারাদণ্ড ও দুই হাজার টাকা জরিমানা। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ নম্বর ধারায় যৌন নিপীড়ন ও শ্লীলতাহানির শাস্তি ১০ বছরের কারাদণ্ড। কিন্তু এসব আইনের প্রয়োগ নেই বললেই চলে। এভাবে তো চলতে পারে না। বখাটেরা যাতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা চাই না, আর একটি সন্তানও বখাটে হোক।
রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন