হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে কিছু দিন আগে সুনামগঞ্জের সিংহ ভাগ ফসল তলিয়ে গেছে। গো-খাদ্যের অভাবে গোয়ালের গরু পানির দামে বিক্রি করছেন কৃষকরা। এমন পরিস্থিতিতে হাওরজুড়ে যখন হাহাকার চলছে, তখন মড়ার উপর খাড়ার ঘাঁ হয়ে দাঁড়িয়েছে পানির বিষাক্ত অ্যামোনিয়া গ্যাস। এই গ্যাসে হাওরের মানুষ যে দু-চারটা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত, সেই মাছও যাচ্ছে মরে। এরই মধ্যে জেলার প্রায় সব হাওরের বেশির ভাগ মাছ মারা গেছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সুনামগঞ্জের সুরমা নদীতে মাছ ধরার হিড়িক চলছে। যে যার মতো ছোট-বড় জাল দিয়ে মাছ ধরছে। যারাই ধরতে এসেছে, তাদের প্রত্যেকের জালেই ধরা পড়ছে বিভিন্ন ধরনের মাছ । ১৫ থেকে ২০ কেজি ওজনের বোয়াল, রুই, আইড় মাছ থেকে শুরু করে বাইন, চিংড়ি, মাগুর, গুলশাসহ সব প্রজাতির ছোট বড় মাছ ধরা পড়ছে। প্রথমে দেখে মনে হবে সুরমা নদীতে মাছ ধরার মহোৎসব চলছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কিছু দিন আগে ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে ৯০ ভাগ ফসল তলিয়ে যায়। ফলে দীর্ঘ দিন পানির নিচে ফসল থাকায় এই ফসল পচে নষ্ট হয়ে হাওরের পানিতে অ্যামোনিয়া জাতীয় বিষাক্ত গ্যাসের সৃষ্টি হয়েছে। আর এ কারণেই পানিতে মাছ শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছে না।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার ষোলঘর এলাকার বাসিন্দা আবদুল জব্বার জানান, বড় আকারের সাত থেকে আটটি আইড় মাছ ধরেছেন তিনি। সেই সঙ্গে অনেক গুলশা, চিংড়ি, বাইন ধরেছেন। তিনি গতকাল সোমবার রাত থেকে আজ মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত সুরমা নদীতে মাছ ধরেছেন।
ষোলঘর এলাকার জুনেদ আহমদ জানান, তিনিও কয়েকটি বড় আইড় ধরেছেন। সেই সঙ্গে বেশ কয়েক কেজি ছোট-বড় মাছ ধরেছেন।
একই উপজেলার কৃষ্ণনগর এলাকার খসরু মিয়া বলেন, গত দুই দিনে তিনি কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪০ কেজি মাছ ধরে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেছেন।
বড়পাড়া এলাকার সোহানুর রহমান সোহান জানান, তিনি কখনো নদীতে মাছ ধরেননি। কিন্তু সোমবার রাতে বেশ কিছু বড় আকারের চিংড়ি মাছ ধরেছেন। মাছে বিষ আছে কি না সে ব্যাপারে কিছু জানেন না। তবে অনেক চিংড়ি মাছ ধরে খুব মজা পেয়েছেন।
সুরমা নদীতে যারাই জাল ফেলেছেন, তারাই মাছ পেয়েছেন। তবে সারা বছর নদীতে যারা মাছ ধরেন, তাঁরা বলেছেন ভিন্ন কথা।
গুদারাঘাট এলাকার মজিদ মিয়া জানান, সারা বছর নদীতে মাছ ধরে সংসার চালান। কিন্তু সেই সারা বছরের মাছ একদিনে নদীতে ধরা পড়ায় শঙ্কায় আছেন। সারা বছর কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করবেন সেই চিন্তায় আছেন।
একই ভাবে ওই এলাকার বাতেন আলী জানান, কিছুদিন আগে হাওরের ধান চলে গেছে। গোয়ালের দুটি গরু ছিল। তাও গরুর খাদ্যের অভাবে বিক্রি করে দিয়েছেন। শেষমেশ নদীর মাছ সব একদিনে ধরা পড়ে যাচ্ছে। আল্লাহ কোন গজব ফেলেছেন তিনি বলতে পারেন না। তবে এবার যে আর শেষ রক্ষা হবে না এই ব্যাপারে তিনি নিশ্চত।
জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ভাষ্য
সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) রফিকুল ইসলাম বলেন, হাওরে ফসল বেশি দিন পানির নিচে থাকার ফলে বিষক্রিয়ায় মাছ মরে গেছে। তিনি মাছ না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। একই সঙ্গে এই পানি ব্যবহার না করারও পরামর্শ দেন তিনি।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শঙ্কর রঞ্জন দাস জানান, পানির গুণাগুণ পরীক্ষা করে দেখা গেছে, পানিতে বিষাক্ত গ্যাস অ্যামোনিয়া বেড়ে যাওয়ায় মাছ শ্বাস নিতে পারছে না। তাই হাওরে চুন দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা। সেই সঙ্গে এই বিষাক্ত আক্রান্ত মাছ না খাওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন।
শঙ্কর রঞ্জন দাস জানান, এখন পর্যন্ত মারা গেছে আনুমানিক ১ দশমিক ১০ মেট্রিক টন মাছ।
সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ জানান, তিনদিন ধরে সুনামগঞ্জে সব হাওরের মাছ মরে যাওয়ার বিষয়টি তিনি জেনেছেন।
‘সুনামগঞ্জের মাছের ওপর এমন হুমকির কথা আমরা রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করেছি। এরই মধ্যে মৎস্য বিভাগের লোকজন হাওরে চুন দিচ্ছেন। এর থেকে উত্তরণের পথ আমরা বের করছি’, বলেন মিসবাহ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন