সময় সংলাপ : অশ্রুভেজা মুসলিম মুখ “রোহিঙ্গা” - সময়ের সংলাপ24
DHAKA WEATHER

Post Bottom Ad

খুব শীগ্রই আমরা Somoyersonglap24.com ওয়েবসাইট নিয়ে আসছি..

সময় সংলাপ : অশ্রুভেজা মুসলিম মুখ “রোহিঙ্গা”

Share This

সময় সংলাপ: গণমাধ্যম এখন নীরব। আর কোনো উচ্চবাচ্য নেই। যেন মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের জীবনের বাঁচামরার সমস্যাটা একদমই দূর হয়ে গেছে। অথচ বাস্তবতা এরকম নয়। নিভুনিভু আগুনের ধোঁয়া আর শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ এখনও তাদের অস্তিত্ব জুড়ে। সবেমাত্র একটি সাম্প্রদায়িক গণহত্যা-পর্ব পার হয়ে এসেছে তারা। সেটাও শেষ হয়ে গেছে-বলা যায়নি। গত ৬ আগস্ট আবার ৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে। আবার রোহিঙ্গাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার ক্ষেত্র প্রস্ত্তত করা হচ্ছে। এখন প্রতিটি দিন কাটছে উদ্বেগে। রাতগুলোতে নামছে আতঙ্কের আর অন্ধকার। কিন্তু দেখার কেউ নেই। পাশে দাঁড়ানো তো অনেক দূরের ব্যাপার!

মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ বা আরাকানের দুঃখী মুসলমানদের বর্তমান অবস্থাটা এরকমই। গত জুনে তাদের ওপর বয়ে গেছে হত্যা, ধর্ষণ ও আগুনে পোড়ানোর নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ। অসহায় শিকার ছিল তারা। রাখাইন জনগোষ্ঠীর লোকেরা আক্রমণের সূচনা করেছে। পরে মিয়ানমারের সামরিক-আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরাও বন্দুক নিয়ে হামলা করেছে। হামলাকারীরা সবাই সরকারি-বেসরকারি, সামরিক-বেসামরিক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। নৃশংসতায় সবাই ছিল সেখানে একাকার। ঘটনাস্থল মিয়ানমারের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকা। রাখাইন প্রদেশের মংডু ও আকিয়াব জেলা। সূত্রপাত গত ৩ জুন। প্রথমে রাখাইন এক নারীকে ধর্ষণ ও হত্যার খবর ছড়িয়ে দেওয়া হয়। দায়ী করা হয় রোহিঙ্গা এক তরুণকে। এরপর ওই প্রদেশের তাংগোকে শহরে বৌদ্ধ উগ্রপন্থীরা ১০ জন নিরীহ মুবাল্লিগ মুসলমানকে গাড়ি থেকে নামিয়ে হত্যা করে। এর প্রতিবাদ করে মুসলমানরা। রাজধানী ইয়াঙ্গুনেও বিক্ষোভ হয়। ৮ জুন শুক্রবার ওই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে মংডু জেলায় বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়। জুমার পর পরই রাখাইন বৌদ্ধরা মুসলমানদের উপর হামলা করে। সংঘর্ষ বেঁধে যায়। ওই সময় নাসাকা সদস্যদের (মিয়ানমারের সীমান্তরী বাহিনী) গুলিতে তিন মুসলমান যুবক শহীদ হন। দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে মংডুর পাশাপাশি আকিয়াব জেলাতেও। তাৎক্ষণিকভাবে সেখানেও আট মুসলমানকে হত্যা করা হয়। এরপর থেকে নারী-পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে হত্যা করা হতে থাকে। গ্রামের পর গ্রাম আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বহু মসজিদ ও মাদরাসা। রোহিঙ্গাদের যাকে যেখানে পাওয়া যায় সেখানেই আঘাত করা হয়। এভাবেই চলে যায় প্রায় আট-দশদিন। সরকারি হিসাবে নিহতের সংখ্যা একশর নিচে হলেও কোনো কোনো সূত্র জানিয়েছে, কয়েক হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। নারকীয় হত্যা ও অগ্নিসংযোগেরে এই চরম মুহূর্তে আহত, অসহায় ও বিপন্ন রোহিঙ্গাদের কোনো কোনো পরিবার নাফ নদী পার হয়ে বাঁচার জন্য বাংলাদেশ সীমান্তে এসে উঠে। তাদের চোখে মুখে একটু আশ্রয় দেওয়ার আকুতি। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশ সীমান্ত বাহিনী-বিজিবি বন্দুক তাক করে তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়। বেদনার ওপর সে অন্য এক বেদনার পর্ব। সেদিকে যাওয়ার আগে দেখা যাক, রোহিঙ্গাদের দুর্দশার শুরু কিভাবে, আর মুসলমানদের নিয়ে মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশ কী করছে?

দুই.
মিয়ানমারের আরাকানে (বর্তমানে রাখাইন প্রদেশ) হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে মুসলমানদের বাস। ওই অঞ্চলে নৃতাত্ত্বিক ও স্থানীয় কিছু ঐতিহ্যের কারণে তারাই রোহিঙ্গা নামে খ্যাত। বেশ কয়েকবার এ এলাকাটি আক্রান্ত হয়, স্বাধীনতা হারায়, নির্যাতিত হয়। সে হিসেবে আরাকানে মুসলিম নিধন ও নির্যাতন অনেক পুরানো একটি বিষয়। তবে গত পোনে এক শতাব্দীকালে এই নির্যাতনের মাত্রা অনেক বেড়েছে। ১৯৩৭ থেকে ২০১২ পর্যন্ত মুসলিমদের টার্গেট করে শতাধিক ছোট-বড় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সহিংসতা ও সামরিক অভিযান চালানো হয়েছে। এ কারণে বহু রোহিঙ্গা স্বদেশত্যাগে বাধ্য হয়। আরাকান সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে এসেও বহু রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয়। ব্যাপক নিপীড়নের শিকার হয়ে ১৯৭৮ ও ১৯৯১ সনে শরণার্থী হিসেবে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা এদেশে আসে এবং শরণার্থী শিবিরে বসবাস করে। তবে বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা পাঁচ লাখের কাছাকাছি। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ইস্যুটি সামনে আসে সেই আশি ও নববইয়ের দশকেই।

জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের ‘বিশ্বের অন্যতম নির্যাতিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বড় দেশগুলোর ভূমিকা এরকম মুখের বুলির ওপরই সীমাবদ্ধ। গত জুনের দাঙ্গার সময় বড় কয়েকটি দেশ ও জাতিসংঘ বাংলাদেশের প্রতি বারবার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার আহবান জানালেও মিয়ানমার সরকারের ওপর কোনো চাপ দেয়নি। কেন মিয়ানমারের মতো দেশে এতবড় ও দীর্ঘ সময় ধরে বর্বোরোচিত পন্থায় মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে-এ নিয়ে তারা কোনো কথাই বলছে না। কেবল মৌখিক জমা-খরচটা তারা দৃশ্যমান রাখছে। যেমন গত মধ্য জুনের ঘটনা সম্পর্কে গত ১ আগস্ট এক প্রতিবেদনে নিউইয়র্ক ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ওই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা, ধর্ষণ ও গণগ্রেফতার করেছে। ওআইসিসহ স্বতন্ত্রভাবে কয়েকটি মুসলিম রাষ্ট্রও মিয়ানমারে সংঘটিত ওই দাঙ্গার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানিয়েছে। সরকারি পর্যায়ে কোনো কোনো দেশে বিক্ষোভ হয়েছে।

তবে, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে মিয়ানমারের ভেতরের চিত্রও সর্বাত্মক হতাশাজনক। তারা সেখানে রাষ্ট্রহীন নাগরিক। তাদের নাগরিকত্বই নেই। বিবাহ, সন্তানধারণ, লেখাপড়া, ব্যবসা-বাণিজ্য, রোহিঙ্গাদের সবকিছুতেই সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও খবরদারি চলে। ১৯৬২ সনে সামরিক সরকার তাদের নাগরিকত্বহীন করেছে। গণতন্ত্রের নেত্রী বলা হয় যে অংসান সূ চিকে, তিনি এবং তার অনুসারীদের কেউ-ই রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার ও নিরাপত্তার পক্ষে কথা বলতে রাজি হননি। রোহিঙ্গাদের যখন হত্যা করা হচ্ছিল সূ চি তখন ‘বকেয়া’ নোবেল পুরস্কার হাতে নিয়ে ইউরোপের দেশে দেশে হাসিমুখে ঘুরছেন। তাকে অসহায় রোহিঙ্গাদের বিষয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেন, ‘আমি জানি না।’ গণমাধ্যমের ব্যাপক প্রশ্ন ও তিরস্কারের মুখে পড়ে গত ২৫ জুলাই মিয়ানমারের সংসদে সূ চি সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় আইন প্রণয়নের একটা আহবান রাখেন। তাতে অবশ্য সার্বক্ষণিকভাবে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের নিয়ে কিছুই বলা হয়নি। সরকার, প্রশাসন, সামরিক বাহিনী, অ-রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, বিরোধীদল সবাই রোহিঙ্গাদের দুর্দশা ও তাদের উৎখাতের পক্ষে ভূমিকা রাখছে। কোনো বৌদ্ধ-প্রধান রাষ্ট্রের এ জাতীয় পরিচিতি সাম্প্রতিক কালে নতুন। একমাত্র ইসরাঈলেরই এত বহুমাত্রিক ও সবার্তমক সাম্প্রদায়িক একটি ভাবমূর্তি ছিল। মিয়ানমারও সে খাতায় এবার নাম লেখালো। মিয়ানমারের সব পক্ষ ও গোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে যে অমানবিক ও বর্বর একটা অবস্থান গ্রহণ করেছে, তা তো পরিষ্কার হয়ে গেছে। কেউ কোনো রাখঢাক রাখেনি। এদের কেউ কেউ বর্বর হত্যা-ধর্ষণ করেছে। আর সবাই তাতে সমর্থন দিয়েছে। ভেবে দেখা উচিত, এখন যদি রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকেই নিপীড়িত ও সর্বস্ব হারানো কেউ অথবা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল কোনো মানুষ মিয়ানমারের বুকে-পিঠে প্রতিরোধের শেল বর্ষানো শুরু করে তাহলে তাকে কতটুকু অপরাধী বলা যাবে?

তিন.
শিশু-মহিলা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাসহ রোহিঙ্গা পরিবারগুলো নৌকায় চড়ে নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে চাইলে বাংলাদেশ সরকার কঠোর আবস্থান নেয়। বিজিবি তাদের জোর করে আবার মিয়ানমারে পুশব্যাক করে। বাংলাদেশ সীমান্তে অসহায় ও প্রত্যাখ্যাত রোহিঙ্গা মুসলিমদের কান্নাঝরা চোখের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে হৃদয়বান প্রতিটি বিবেকে ধাক্কা লাগে। নড়েচড়ে ওঠে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল। জাতিসংঘ, আমেরিকা, কানাডাসহ পশ্চিমা বিশ্বের বড় কয়েকটি দেশ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসি বাংলাদেশ সরকারের কাছে আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য মানবিক আবেদন করে। দেশের ভেতরে প্রধান বিরোধী দলসহ বিভিন্ন, রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি, ইসলামি সংগঠনগুলোও বন্দুকের নলের মুখে আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গাদের আবারো মিয়ানমারের বধ্যভূমিতে ফেরত না পাঠানোর দাবি জানায়। কিন্তু এতসব কিছুর পরও আমাদের সরকার তার ‘আমানবিক, অ-কূটনৈতিক ও অ-ভ্রাতৃসুলভ’ সিদ্ধান্তে অটল থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের বিভিন্ন অন্যয্য সহযোগিতার ক্ষেত্রে দৃষ্টিকটুভাবে নমনীয় হলেও আমাদের সরকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দেওয়ার সিদ্ধান্তে ‘দৃঢ়তার’ নতুন নিদর্শন স্থাপন করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাতীয় সংসদসহ বিভিন্ন সংবাদ ব্রিফিং ও বক্তব্যে সরকারের এ অনমনীয় অবস্থানের কথা নানা শব্দে, নানা ভাষায় তুলে ধরেন। যেসব বক্তব্য তিনি দিয়েছেন তার কয়েকটি এখানে তুলে ধরা হল।

* ‘মিয়ানমারে কোনো যুদ্ধাবস্থা চলছে না, সে দেশের সরকারও কাউকে বিতাড়িত করছে না। তাই আন্তর্জাতিক কোনো আইনেই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে সীমান্ত খুলে দিতে বাংলাদেশ বাধ্য নয়।’

* ‘বাংলাদেশের এক ইঞ্চি মাটিও প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ক্ষতির জন্য কাউকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। আর কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়েও বাংলাদেশ হস্তক্ষেপ করতে পারে না।’

* ‘বাংলাদেশ দূতাবাসের কাছে মিয়ানমার সরকার উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছে, বাংলাদেশে থাকা কিছু রোহিঙ্গা সংগঠনকে একটি রাজনৈতিক দল (জামায়াত ইসলামী) সশস্ত্র

হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মিয়ানমারে সহিংসতায় ইন্ধন যোগাতে কাজ করছে। এ অভিযোগকে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ, আমাদের ভূমি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর কিছু করার কাজে ব্যবহার করতে দেব না। জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে কোনো কাজ করতে দেব না। আমরা এ সমস্যাকে আর বড় হতে দিতে চাই না।’

* ‘কয়েক দিন ধরে মিয়ানমারে কিছু জাতিগত সহিংসতা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আমরা বিজিবিসহ সীমান্ত রক্ষীবাহিনীকে সতর্ক অবস্থায় রেখেছি। ১৯৭১ সালে আমাদের যে অভিজ্ঞতা, পাশের দেশ ভারতে এক কোটি লোক শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিল এটা আমরা কখনোই ভুলে যাই না। ভুলে যাই না বলেই কোথাও এ ধরনের ঘটনা দেখলেই তাদের পাশে দাঁড়াই। বাংলাদেশ সব সময় তাই করে।’

* ‘একাত্তরে দেশে যুদ্ধাবস্থা ছিল। গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট চলছিল। তখন অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার ভারত সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছিল, যাতে শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়। আমরা কৃতজ্ঞ যে, ইন্দীরা গান্ধী সরকার ও ভারতীয় জনগণ আমাদের শরণার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিল।’

* ‘আমরা আন্তর্জাতিক শরণার্থী কনভেনশনে অনুসাক্ষরকারী রাষ্ট্র নই। তাই কোনো কনভেনশন বা প্রটোকল অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের দায়বদ্ধতা নেই। কোনো আন্তর্জাতিক আইনে বাধ্যবাধকতা না থাকার পরও ১৯৭১ সালের অভিজ্ঞতায় আমরা শুধু মানবিক কারণে দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গাদের আমাদের দেশে থাকতে দি""ছ। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক প্রথাগত কোনো আইনেও কোনো দেশ অন্য একটি দেশের মানুষকে আশ্রয় দেয়ার জন্য সীমান্ত খুলে দিতে বাধ্য নয়।’

* ‘আজকের মিয়ানমারের পরিস্থিতি, আর একাত্তরের পরিস্থিতি এক নয়। দুটি জাতিগত গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত চলছে। এতে রাষ্ট্র বা সরকারের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। বরং সমস্যা সমাধানে মিয়ানমার সরকার নিরলস চেষ্টা করছে বলেই আমরা মনে করি।’

* ‘কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে আমাদের সংবিধানে। এটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। সেখানে আমাদের হস্তক্ষেপ করা সংবিধানসম্মত হবে না।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ জাতীয় বক্তব্যে দেশপ্রেমিক ও ধর্মপ্রাণ সাধারণ জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠেছেন দেশের সুশীল সমাজ, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক-কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের কেউ কেউ বলেছেন-

বর্তমানে রোহিঙ্গা ইস্যুটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু আদতেই কি তাই? মোটেই এই ইস্যুটি মিয়ানমারের

অভ্যন্তরীণ ইস্যু নয়। মিয়ানমারের জাতিগত সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন চললে অবশ্যম্ভাবীভাবে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের ওপর। সেখান থেকে শরণার্থী আসতে থাকে বাংলাদেশে। বাংলাদেশর সরকারের ওপর অভ্যন্তরীণ ও আর্ন্তজাতিক চাপ বাড়ে। কাজেই মিয়ানমার তার ঘরে আগুন লাগিয়ে নিজেদের সংখ্যালঘু মুসলমানদের নির্বিচারে পোড়াতে থাকলে আমাদের চোখ বন্ধ করে, কানে আঙ্গুল দিয়ে থাকার উপায় নেই। এর রাজনৈতিক ক্ষেত্রগুলো বিবেচনায় নিয়ে ন্যায্যভাবে সাড়া দেবার বিষয়ে তৎপর হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই বাংলাদেশের।’

‘কেউ কেউ আরও বলেন আমরা সংসদে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর তীব্র, কঠিন ভাষার অমানবিক বক্তব্য শুনেছি কিন্তু মিয়ানমারের রাষ্ট্রশাসকদের সঙ্গে কূটনৈতিক চ্যানেলে আলোচনার কোনো উদ্যোগ দেখিনি। এই ইস্যুটিকে মানবিক দৃষ্টি দিয়ে বিবেচনায় নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনা করার এই সুযোগ বাংলাদেশ কেন ছাড়ছে, সেটা বোঝা মুশকিল।’

চার.
আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গারা ছিলেন মুসলমান। এই পরিচিতিই মিয়ানমারে তাদের নিরাপদ অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে গিয়েছিল। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি নিয়েই তাদের সমূলে উৎপাটনের অপারেশন শুরু হয়েছিল। একই ব্যাপার কি বাংলাদেশ সরকারের ক্ষেত্রেও ঘটছে? কারো কারো মতে ব্যাপারটি সেরকমই ছিল। এরা মুসলমান হওয়ার‘অপরাধেই’ ভ্রাতৃপ্রতিম অরেক দেশের সীমান্তে এসে হাত জোড় করে চোখের পানি ঝরিয়েও প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার ২১ জুন সংখ্যায় এদিকেই ইঙ্গিত করে লেখা হয়েছে-‘বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই ইস্যুকে যেভাবে ডিল করছেন, তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এবং ভাষা যে ইমেজ তৈরি করছে তাতে মনে হচ্ছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিনি ‘ইসলাম ফোবিয়া’তে ভুগছেন। রোহিঙ্গারা ধর্মে মুসলমান, চেহারায় বাঙালি, ভাষাতে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। সেই কারণেই কি ডা. দিপু মনি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যুর সঙ্গে বাংলাদেশের ধর্মীয় পরিচিতি বহনকারী একটি সংগঠনের রাজনীতিকে জড়িয়ে ফেলছেন? নিজ থেকে এরকম আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে বিশ্ববাসীকে তিনি কি বার্তা দিতে চাইছেন? ...’

‘এবার উল্টো দিক দিয়েও বিবেচনা করা যেতে পারে। রোহিঙ্গাদের বদলে মিয়ানমার থেকে যদি সংখ্যালঘু হিন্দু, খ্রিস্টান কিংবা সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন জাতিগত নিপীড়নের শিকার হয়ে নাফ নদী হয়ে টেকনাফে ঢুকতে চায়, ডা. দিপু মনি কি একই বডি ল্যাঙ্গুয়েজে একই ভাষায় একই আচরণ করতেন? নাকি প্রতিবেশী বড় দেশের রাজনৈতিক প্রভাবের কথা ভেবে ভিন্ন আচরণ করতেন? দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের ভোট বঞ্চিত হবে বলে সংবিধানের সংশোধনীতে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম বাদ দিতে ভয় পেয়েছে যে আওয়ামী লীগ, সেই সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই ‘ইসলাম ফোবিয়া’ কতটা প্রাসঙ্গিক সেটাও বিবেচনার দাবি রাখে?’

একই প্রবণতা দেখা গেছে গণমাধ্যমের ভাষায় ও শব্দে। দাঙ্গার শুরু থেকেই এদেশের প্রভাবশালী বেশ কয়েকটি মিডিয়া মিয়ানমারের রাখাইন (আরাকান) প্রদেশে বৌদ্ধদের চাপিয়ে দেওয়া এই দাঙ্গাকে বিশেষায়িত করেছে‘জাতিগত দাঙ্গা’ হিসেবে। ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা’ হিসেবে চিত্রিত করতে তারা কুণ্ঠিত হয়েছে। যদিও মূল ব্যাপার ছিল সেটিই। রোহিঙ্গা আর রাখাইন দু’টি পৃথক জাতিগোষ্ঠী হলেও মূল বিষয় ছিল ধর্মের ভিন্নতা। একারণেই রোহিঙ্গাদের পাইকারি হারে হত্যা করার সময় সামরিক বাহিনীর সদস্যরাও হত্যাকারীদের সাহায্য করেছে। সরকার ও বিরোধীদলীয় কেউ কোনো উদ্যোগই নেয়নি। কারণ, তারাও বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। রাখাইনদের হত্যা করার এবং রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিহত ও দেশছাড়া হওয়ার পথ করে দিয়েছে। সবাই মিলে। কিন্তু এ সত্যটা বাংলাদেশের মিডিয়াগুলো বহুলাংশে উচ্চারণ করতেই চায়নি। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা দরকার যে, দেশের এ মিডিয়াগুলোই এখানকার ইসলামপন্থী নিয়মতান্ত্রিক দলগুলোর রাজনীতিকে অভিহিত করে ‘সাম্প্রদায়িক রাজনীতি’ হিসেবে। আর ভারতের বিজেপির মুসলিম হত্যা ও বাবরী মসজিদ ধ্বংসের রাজনীতিকে ‘উগ্র জাতীয়তাবাদী’ রাজনীতি হিসেবে অভিহিত করে কিছুটা বৈধতা দেওয়ার কসরত করে। অ-মুসলিমরা ধর্মীয় ভেদবুদ্ধি তাড়িত হয়ে খুন-জখম ও বর্বরতা চালালে সেটা থাকে ‘উগ্র জাতীয়তাবাদ’ আর মুসলিমরা শুধু তাদের সর্বজনীন ধর্মাদর্শের ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্রগঠনের চিন্তা নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করলে (তাতে অমুসলিমদের কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রতি কোনো হুমকি না থাকলেও) সেটা নাম পেয়ে যায় ‘সাম্প্রদায়িক রাজনীতি’। হীনম্মন্যতার এই স্তর ও প্রবণতাগুলো অবশ্যই ভাবনার উদ্রেককারী । এই হীনম্মন্যতার মধ্য দিয়েই বহু জিনিস চিনতে ভুল হয়। বহু জিনিস আমাদের ভুলভাবে চেনানো হয়।

পাঁচ.
রোহিঙ্গা মুসলমানদের আশ্রয় না দেওয়ার পক্ষে বড় যুক্তিটা ছিল তাদের ‘বোঝা’ মনে করা। পেছনে ছিল আর্থিক ও সমাজিক দায় না বাড়ানোর অজুহাত। কিন্তু নিপীড়িত ও আশ্রয়প্রার্থী মুসলমানদের সঙ্গে অপর কোনো মুসলমানপ্রধান রাষ্ট্রের আচরণ কি বাস্তব এমন হতে পারে? ইসলামের শুরু থেকে এ পর্যন্ত বিপদগ্রস্ত ও স্বদেশ ত্যাগ করা উদ্বাস্ত মুসলমানদের অপর মুসলিম দেশে গ্রহণ করার ঐতিহ্যটিতো দ্বীনী নীতি ও চেতনা দ্বারাই সমর্থিত। এবার খুব নিষ্ঠুর ভাবে সে ঐতিহ্য থেকে বাংলাদেশকে দূরে সরিয়ে রাখা হল।

হাদীস শরীফের একটি বাক্যের প্রতি আমরা লক্ষ্য করতে পারি। হাদীসে আছে, ‘তোমাদের রিজিক দেওয়া হয় তোমাদের মধ্যের দুর্বল লোকদের কারণে।’ রোহিঙ্গরা ছিল নিপীড়িত ও দুর্বল। তাদের আশ্রয় দেওয়া এবং তাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত বর্বরতার প্রতিবাদ করা ছিল আমাদের প্রধান দায়িত্ব। জানি, আমাদের সম্পদ ও অয়োজনে অনেক ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু এ কথাও তো সত্য যে, গত ২০/৩০ বছরে অমরা খনিজ সম্পদ ও সম্ভাবনার বহু নেয়ামতও পেয়েছি। এ নেয়ামত আমাদের হাতের কামাই ছিল না। এদেশে এটা আল্লাহ তাআলা দান করেছেন। দুর্বল অসহায়দের আশ্রয় দেওয়া-না দেওয়ার চিন্তার সময় আর্থিক অসঙ্গতি ও অন্যান্য দায়ের পাশাপাশি এ দেশে আল্লাহর দানের কথাও চিন্তা করা উচিত। নিজেদের একটু স্বাচ্ছন্দ বিঘ্নিত হওয়ার ভয়ে জীবনের ঝুঁকিতে থাকা বিপন্ন মানুষকে, বিপন্ন মুসলিমকে লাথি মেরে তাড়িয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা আমাদের প্রতি আগত ও অনাগত বহু সৌভাগ্যের সম্ভাবনাকেও পদাঘাত করলাম কি না ভেবে দেখা দরকার।

একটি মুসলিমরাষ্ট্রের নৈতিক দায় এবং ভ্রাতৃত্বের জোর অনেক বেশি থাকাই প্রাসঙ্গিক। আজ কি রাষ্ট্রটি সেক্যুলার হয়ে যাওয়ায় সেসব দায় ও জোর আমরা ঝেড়ে ফেলতে চাচ্ছি?

বাস্তবতা বড় কঠোর। দেশ-জাতি-গোষ্ঠীর মাঝে সুসময়-দুঃসময় আবর্তিত হতে থাকে। কখন যে আমাদের কোন দুঃসময়ে আমরা অপর ভাইদের ‘নির্মম’ চেহারা অসহায় চোখে দেখতে বাধ্য হব-কে জানে। সেজন্য অন্য ভাইয়ের প্রতি নির্দয় ও নিষ্ঠুর হওয়ার আগে নিজের দুরবস্থার কল্পনাটা একটু করা দরকার। সামর্থ্য-অসামর্থ্য, দোষ-গুণ-সবকিছুর বাইরে রোহিঙ্গারা তো আমাদের ভাই। মুসলিম ভাই। আজ তাদের গায়ে মারখাওয়ার দাগ, রক্তের ছাপ। আজ তাদের মুখ অশ্রুভেজা। ভাই-বোনের এই লাখো ভেজা মুখের অশ্রু মোছার কোনো দায়িত্বই কি আমাদের ছিল না? এখন নেই? ভবিষ্যতে থাকবে না? -সময়ের সংলাপ24/ডি-এইচ

কোন মন্তব্য নেই: