ভালোবাসা একটি মানবিক অনুভূতি। বলা যায় আবেগকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতা। বিশেষ কোন মানুষের জন্য স্নেহের শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে ভালোবাসা। তবুও ভালোবাসাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাগ করা যায়। আবেগধর্মী ভালোবাসা সাধারণত গভীর হয়,বিশেষ কারো সাথে নিজের সকল মানবীয় অনুভূতি ভাগ করে নেয়া, এমনকি শরীরের ব্যাপারটাও এই ধরনের ভালোবাসা থেকে পৃথক করা যায়না। ভালোবাসা বিভিন্ন রকম হতে পারে, যেমন: নিস্কাম ভালোবাসা, ধর্মীয় ভালোবাসা, আত্মীয়দের প্রতি ভালোবাসা ইত্যাদি। আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে, যে কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি অতিরিক্ত স্নেহ প্রায় সময় খুবই আনন্দদায়ক হতে পারে…এমনকি কোন কাজ কিংবা খাদ্যের প্রতিও। আর এটাই অতি আনন্দদায়ক অনুভূতিই হলো ভালোবাসা।
তোমারই যে বলো দিবস রজনী, ‘ভালোবাসা ভালোবাসা- সখী ভালোবাসা কারে কয় । সে কি কেবলই যাতনাময় সেকি চোখের জল?
আদৌ রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায় মনে পড়ে মোর প্রিয় । চাঁদ হয়ে রব আকাশের গায়।
প্রথমটি কবিতার চুম্বক অংশটি কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেম ভালোবাসা নিয়ে লিখা কবিতার একটি অংশ আর পরের কবিতাটি জাতীয় কবি কাজী নজরুলের কবিতার একটি অংশ।
প্রকৃত পৃথিবীর সব সাহিত্য ডুবে আছে ভালোবাসা নিয়ে কাব্য–মহাকাব্য কবিতা গান আর উপন্যাসের অতলান্তে।
যুগে যুগে ভালোবাসার মাধ্যমঃ যুগে যুগে ভালোবাসা নিবেদন হয়েছে কত নিয়মে তার কোন ইয়াত্তা নেই। ভালোবাসার ক্ষেত্রেও এসছে কত পরিবর্তন, অসেছে আধুনিকতার চোঁয়া।
প্রথম যুগে চিঠির মাধ্যমে জানানো হতো ভালোবাসার নিবেদন। তখন দেশের বন্ধু বা প্রিয়জন তার প্রিয়তমকে চিঠির মাধ্যমে ভালোবাসার কথা জানানো হতো। এক সময় কৃষক শ্রমিক রাখালের সুরেলা কণ্ঠে এসব গানই শোনা যেত, কিন্তু কালের পরিক্রমায় ডিজিটাল জামানায় শোনা যায় পশ্চিমা ধাঁচের ব্যান্ডের আগমনের ফলে চাপা পড়তে থাকে কৃষকের সেই সুরেলা কন্ঠ। চিঠি লেখা যেভাবে ইতিহাসের মলাটে বন্দি হয়ে গেছে, সেভাবে চিঠি সংক্রান্ত জনপ্রিয় গানও ইতিহাসের মলাটেই বন্দি হওয়ার পথে।
এক কালে দেশ-বিদেশে স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ ও কুশল বিনিময়ের সর্বোত্তম ও বহুল প্রচলিত জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে চিঠি লেখার এবং চিঠি আদান-প্রদানের ঐতিহ্যবাহী রেওয়াজ ছিল বাংলাদেশের ঘরে ঘরে।
যানা যায়, প্রাচীন আমলের রাজা-বাদশাহরাও দূত মারফত বিভিন্ন রাষ্ট্র, সরকারপ্রধান বা অধীনস্থ রাজ্য প্রধানদের সঙ্গে একমাত্র চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। ডিজিটাল এ জামানায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের ফলে বর্তমানে ইন্টারনেট, ই-মেইল, ভয়েস মেইল, চ্যাটিং, ফোন ও মোবাইলের যুগে আজ তা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। জাদুঘরের বন্ধ খাঁচার দিকে ক্রমেই ধাবমান আর ইতিহাসের পাতায় বন্দি হওয়ার মতো অবস্থা। ই-মেইল, ফেসবুক, টুইটার, এসএমএস, মাল্টিমিডিয়া মেসেজ, ফ্লাশ মেসেজ, অডিও মেসেজ, টেলিকানেকশন ও মোবাইলের জয়-জয়কারে দেশ-বিদেশের স্বজনদের সঙ্গে পত্র যোগাযোগ এখন সেকেলে মডেলে পরিণত হয়েছে। এই ক’বছর আগেও সিলেটসহ সারা দেশেই পোস্ট অফিসের ডাকপিয়নের কদর ছিল আকাশচুম্বি। ডাকঘর খোলার অনেক আগে থেকেই সর্বসাধারণের দারুণ ভিড় দেখা যেত পোস্ট অফিসের আঙ্গিনায়। অনেকেই বসে বসে প্রতীক্ষার প্রহর গুনতেন—কবে কখন আসবেন ডাকপিয়ন। ডাকপিয়ন এসে অফিস খোলার পরই ডাকে আসা চিঠি বের করে সিল মেরে এক-একটি চিঠি হাতে নিয়ে এয়ারলেটার বা খামের ওপর উল্লিখিত প্রাপকের নাম ধরে ধরে উচ্চস্বরে ডাকতেন। তখন সেখানে উপস্থিত লোকজন নিজ নিজ চিঠি, আত্মীয়দের চিঠি বা পাশের বাড়ির চিঠি নিজ হাতে সমঝে নিয়ে যেতেন বাড়িতে। বাড়িতে যাওয়ার পর চিঠি খুলে সবাই খুশিতে জড়ো হয়ে পড়া শুনতেন। পড়া জানা না থাকলে পাশের বাড়ির কোনো পড়া জানাশোনা ব্যক্তির কাছে গিয়ে চিঠি পড়া শুনে তার মর্ম অবগত হতেন। সমস্যা হতো স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে দেয়া চিঠি পড়াতে বা স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে দেয়া চিঠি লেখাতে। তখন পাঠক বা লেখক খোঁজা হতো নিতান্ত আপনজনকে। কারণ স্বামী স্ত্রীকে যে মধুমাখা আবেগ দ্বারা চিঠি দিতেন তা সবার দ্বারা পাঠ করানো সম্ভব হতো না এজন্য যে, এতে স্ত্রীর লাজ-শরমের একটা ব্যাপার-স্যাপার আছে। আগেকার যুগে পাড়া-মহল্লায় চিঠি লেখকদের যথেষ্ট কদর ছিল। যারা চিঠি লেখাতেন বা পাঠ করাতেন তারা এদেরকে সব সময় সমীহ করে চলতেন এবং সময়-সুযোগ মতো দাওয়াতও খাওয়াতেন। প্রেরক চিঠি লেখকের বাড়ি বার বার হানা দিতেন একটা চিঠি লেখানোর জন্য। চিঠি লেখক ব্যস্ত থাকলে বলতেন পরে সুবিধাজনক সময়ে আসতে। এভাবে অনেক সময় চিঠি লেখকের বাড়িতে বার বার চক্কর দিয়ে অনুনয়-বিনয় করতে হতো একটি চিঠি লেখানোর জন্য।
আগেকার যুগে প্রেমিক-প্রেমিকার যোগাযোগ বা প্রেম নিবেদনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বহুলপ্রচলিত মাধ্যমও ছিল চিঠি আদান-প্রদান। মুখ ফুটে সরাসরি প্রেমের আবেদন জানানোর সাহস না করে চিঠির মাধ্যমে প্রেম নিবেদন করে অপেক্ষার প্রহর গোনা হতো প্রতিউত্তরের। এতে নানা ধরনের মুখরোচক ও আবেগময় লেখা থাকত। প্রেমের চিঠি আদান-প্রদানের সময় বন্ধু বা বান্ধবীর প্রতিবেশী বা সমমনা বন্ধু-বান্ধব অথবা বাড়ির ছোট ছোট ইচড়েপাকা কিশোর-কিশোরীকে ব্যবহার করা হতো এবং এ কাজের জন্য তাদের নানান ধরনের পুরস্কারেও ভূষিত করা হতো। প্রেমিক বা প্রেমিকা চিঠি পেয়ে সাড়া দিলে তখনি চিঠির উত্তর দিয়ে চিঠি চালাচালির মাধ্যমে প্রেমের প্রথম পর্ব শুরু হতো। আবার অনেকে প্রেম প্রত্যাখ্যান করলে চিঠি ছিঁড়ে বা পুড়িয়ে ফেলত। বাহকের কাছ থেকে যে কোনোভাবে জায়গামতো না গিয়ে অভিভাবক বা মুরব্বি কারও হাতে চিঠি গেলে বিচার-আচার কিংবা ঝগড়াঝাটি-মারামারিও হতো। অনেকেই নিজে চিঠি লেখার বা লেখানোর পরও বার বার পাঠ করে শুনতেন বা শোনাতেন যাতে কোনো তথ্য অসম্পূর্ণ না থাকে। চিঠি লেখার কলাকৌশল, উন্নত ও আবেগময় ভাষা শেখার জন্য বাজারে রং-বেরঙের ছোট ছোট বইয়ের কদর ছিল আকাশচুম্বী।
নব্বই দশকের আগে থেকেই দেশের প্রতিটি জেলা সদর এবং পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন উপজেলা সদরে ডিজিটাল টেলিফোন ব্যবস্থার সুবাদে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপের প্রায় সব দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশের প্রবাসীদের সঙ্গে সরাসরি ফোনে কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি হয়। কিন্তু মিনিটে স্থানভেদে একশ’ থেকে দেড়শ’ টাকা করে বিল আসায় নিতান্ত অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ টেলিফোন করতেন না। তাও দু-চার মিনিটের মধ্যেই আলাপ সীমাবদ্ধ থাকত। দীর্ঘ আলাপ হলে রিভার্স কল করা হতো যাতে প্রবাসীকে কল ব্যাকের মেসেজ দেয়া হতো, কল এলে রিভার্স কলের বিল দেয়া হতো। এছাড়া এরও আগে অতি জরুরি খবর পৌঁছানোর জন্য টেলিগ্রামের প্রচলন ছিল।
বর্তমানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে স্বল্প খরচে চ্যাটিং করা যায় এবং উভয় উভয়ের আলাপ সরাসরি শোনার পাশাপাশি দেখতেও পারে ওয়েব ক্যামেরার মাধ্যমে মনিটরের পর্দায়। ফেসবুকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাতচিত করা যায়। চার-পাঁচ টাকা মিনিটে আমেরিকা, কানাডা ও ইউরোপের প্রায় সব দেশেই ফোন করা যায়। নেট কলিং কার্ড মোবাইলে ঢুকিয়ে নিজ মোবাইলের মাধ্যমে স্বল্প মূল্যে আলাপ করা যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এছাড়া মোবাইলের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কলচার্জ ব্যাপকভাবে হ্রাস পাওয়ায় অনেকেই নিজের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সরাসরি ফোন করে ভাবের আদান-প্রদান করেন হরহামেশাই। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রবাসীরা বিদেশ থেকে ইন্টারনেট কার্ডের মাধ্যমে দেশে স্বজনদের মোবাইলে বা ফোনে আলাপ করেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
হাল জামানায় যাদের বাড়িতে আইএসডি টেলিফোন সংযোগ নেই তাদেরও কোনো ভাবনা নেই। স্বল্প মূল্যে পাওয়া যায় আইএসডি মোবাইলের সিম। অথবা দেশের যে কোনো মোবাইল থেকে প্রবাসীর কাছে মুহূর্তে এসএমএস পাঠানো যায় ‘প্লিজ কল ব্যাক’। তখন প্রবাসীরা সঙ্গে সঙ্গে অথবা সময়-সুযোগ মতো কল ব্যাক করেন। প্রবাসীরা বর্তমানে দেশে রেমিটেন্সও পাঠাতে পারেন মুহূর্তে। মোবাইল ফোনে জানিয়ে দেন টাকা পাঠানোর খবর ও পিন নম্বর। মুহূর্তে ব্যাংকে গিয়ে টাকা তুলে আনা যায় অনায়াসে। এছাড়া মোবাইল রেমিটেন্স তো আছেই। আগের যুগে বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে গেলে পাত্রী চিঠিপত্র লিখতে পারে কিনা যাচাই করা হতো এমনকি হাতের লেখাও দেখা হতো সুন্দর কি না। বর্তমান ডিজিটাল যুগে কনে কম্পিউটারে কতটুকু পারদর্শী তা জানার রেওয়াজ এসে গেছে। চিঠি লেখার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায় না লিখে লিখে অনেকেরই হাতের লেখা বসে যাচ্ছে অথবা হাতের লেখা ঝালাই দিতে পারছেন না। আর ডিজিটাল এ যুগে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে চিঠি লেখার অভ্যাস। প্রয়াত কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর লেখা জনপ্রিয় গান ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো এখন আর তেমন একটা গাইতে শোনা যায় না।
লেখক: সাংবাদিক ও অধ্যয়ণরত মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (সাংবাদিকতা ও গণসংযোগ বিভাগ)।
তোমারই যে বলো দিবস রজনী, ‘ভালোবাসা ভালোবাসা- সখী ভালোবাসা কারে কয় । সে কি কেবলই যাতনাময় সেকি চোখের জল?
আদৌ রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায় মনে পড়ে মোর প্রিয় । চাঁদ হয়ে রব আকাশের গায়।
প্রথমটি কবিতার চুম্বক অংশটি কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেম ভালোবাসা নিয়ে লিখা কবিতার একটি অংশ আর পরের কবিতাটি জাতীয় কবি কাজী নজরুলের কবিতার একটি অংশ।
প্রকৃত পৃথিবীর সব সাহিত্য ডুবে আছে ভালোবাসা নিয়ে কাব্য–মহাকাব্য কবিতা গান আর উপন্যাসের অতলান্তে।
যুগে যুগে ভালোবাসার মাধ্যমঃ যুগে যুগে ভালোবাসা নিবেদন হয়েছে কত নিয়মে তার কোন ইয়াত্তা নেই। ভালোবাসার ক্ষেত্রেও এসছে কত পরিবর্তন, অসেছে আধুনিকতার চোঁয়া।
প্রথম যুগে চিঠির মাধ্যমে জানানো হতো ভালোবাসার নিবেদন। তখন দেশের বন্ধু বা প্রিয়জন তার প্রিয়তমকে চিঠির মাধ্যমে ভালোবাসার কথা জানানো হতো। এক সময় কৃষক শ্রমিক রাখালের সুরেলা কণ্ঠে এসব গানই শোনা যেত, কিন্তু কালের পরিক্রমায় ডিজিটাল জামানায় শোনা যায় পশ্চিমা ধাঁচের ব্যান্ডের আগমনের ফলে চাপা পড়তে থাকে কৃষকের সেই সুরেলা কন্ঠ। চিঠি লেখা যেভাবে ইতিহাসের মলাটে বন্দি হয়ে গেছে, সেভাবে চিঠি সংক্রান্ত জনপ্রিয় গানও ইতিহাসের মলাটেই বন্দি হওয়ার পথে।
এক কালে দেশ-বিদেশে স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ ও কুশল বিনিময়ের সর্বোত্তম ও বহুল প্রচলিত জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে চিঠি লেখার এবং চিঠি আদান-প্রদানের ঐতিহ্যবাহী রেওয়াজ ছিল বাংলাদেশের ঘরে ঘরে।
যানা যায়, প্রাচীন আমলের রাজা-বাদশাহরাও দূত মারফত বিভিন্ন রাষ্ট্র, সরকারপ্রধান বা অধীনস্থ রাজ্য প্রধানদের সঙ্গে একমাত্র চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। ডিজিটাল এ জামানায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের ফলে বর্তমানে ইন্টারনেট, ই-মেইল, ভয়েস মেইল, চ্যাটিং, ফোন ও মোবাইলের যুগে আজ তা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। জাদুঘরের বন্ধ খাঁচার দিকে ক্রমেই ধাবমান আর ইতিহাসের পাতায় বন্দি হওয়ার মতো অবস্থা। ই-মেইল, ফেসবুক, টুইটার, এসএমএস, মাল্টিমিডিয়া মেসেজ, ফ্লাশ মেসেজ, অডিও মেসেজ, টেলিকানেকশন ও মোবাইলের জয়-জয়কারে দেশ-বিদেশের স্বজনদের সঙ্গে পত্র যোগাযোগ এখন সেকেলে মডেলে পরিণত হয়েছে। এই ক’বছর আগেও সিলেটসহ সারা দেশেই পোস্ট অফিসের ডাকপিয়নের কদর ছিল আকাশচুম্বি। ডাকঘর খোলার অনেক আগে থেকেই সর্বসাধারণের দারুণ ভিড় দেখা যেত পোস্ট অফিসের আঙ্গিনায়। অনেকেই বসে বসে প্রতীক্ষার প্রহর গুনতেন—কবে কখন আসবেন ডাকপিয়ন। ডাকপিয়ন এসে অফিস খোলার পরই ডাকে আসা চিঠি বের করে সিল মেরে এক-একটি চিঠি হাতে নিয়ে এয়ারলেটার বা খামের ওপর উল্লিখিত প্রাপকের নাম ধরে ধরে উচ্চস্বরে ডাকতেন। তখন সেখানে উপস্থিত লোকজন নিজ নিজ চিঠি, আত্মীয়দের চিঠি বা পাশের বাড়ির চিঠি নিজ হাতে সমঝে নিয়ে যেতেন বাড়িতে। বাড়িতে যাওয়ার পর চিঠি খুলে সবাই খুশিতে জড়ো হয়ে পড়া শুনতেন। পড়া জানা না থাকলে পাশের বাড়ির কোনো পড়া জানাশোনা ব্যক্তির কাছে গিয়ে চিঠি পড়া শুনে তার মর্ম অবগত হতেন। সমস্যা হতো স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে দেয়া চিঠি পড়াতে বা স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে দেয়া চিঠি লেখাতে। তখন পাঠক বা লেখক খোঁজা হতো নিতান্ত আপনজনকে। কারণ স্বামী স্ত্রীকে যে মধুমাখা আবেগ দ্বারা চিঠি দিতেন তা সবার দ্বারা পাঠ করানো সম্ভব হতো না এজন্য যে, এতে স্ত্রীর লাজ-শরমের একটা ব্যাপার-স্যাপার আছে। আগেকার যুগে পাড়া-মহল্লায় চিঠি লেখকদের যথেষ্ট কদর ছিল। যারা চিঠি লেখাতেন বা পাঠ করাতেন তারা এদেরকে সব সময় সমীহ করে চলতেন এবং সময়-সুযোগ মতো দাওয়াতও খাওয়াতেন। প্রেরক চিঠি লেখকের বাড়ি বার বার হানা দিতেন একটা চিঠি লেখানোর জন্য। চিঠি লেখক ব্যস্ত থাকলে বলতেন পরে সুবিধাজনক সময়ে আসতে। এভাবে অনেক সময় চিঠি লেখকের বাড়িতে বার বার চক্কর দিয়ে অনুনয়-বিনয় করতে হতো একটি চিঠি লেখানোর জন্য।
আগেকার যুগে প্রেমিক-প্রেমিকার যোগাযোগ বা প্রেম নিবেদনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বহুলপ্রচলিত মাধ্যমও ছিল চিঠি আদান-প্রদান। মুখ ফুটে সরাসরি প্রেমের আবেদন জানানোর সাহস না করে চিঠির মাধ্যমে প্রেম নিবেদন করে অপেক্ষার প্রহর গোনা হতো প্রতিউত্তরের। এতে নানা ধরনের মুখরোচক ও আবেগময় লেখা থাকত। প্রেমের চিঠি আদান-প্রদানের সময় বন্ধু বা বান্ধবীর প্রতিবেশী বা সমমনা বন্ধু-বান্ধব অথবা বাড়ির ছোট ছোট ইচড়েপাকা কিশোর-কিশোরীকে ব্যবহার করা হতো এবং এ কাজের জন্য তাদের নানান ধরনের পুরস্কারেও ভূষিত করা হতো। প্রেমিক বা প্রেমিকা চিঠি পেয়ে সাড়া দিলে তখনি চিঠির উত্তর দিয়ে চিঠি চালাচালির মাধ্যমে প্রেমের প্রথম পর্ব শুরু হতো। আবার অনেকে প্রেম প্রত্যাখ্যান করলে চিঠি ছিঁড়ে বা পুড়িয়ে ফেলত। বাহকের কাছ থেকে যে কোনোভাবে জায়গামতো না গিয়ে অভিভাবক বা মুরব্বি কারও হাতে চিঠি গেলে বিচার-আচার কিংবা ঝগড়াঝাটি-মারামারিও হতো। অনেকেই নিজে চিঠি লেখার বা লেখানোর পরও বার বার পাঠ করে শুনতেন বা শোনাতেন যাতে কোনো তথ্য অসম্পূর্ণ না থাকে। চিঠি লেখার কলাকৌশল, উন্নত ও আবেগময় ভাষা শেখার জন্য বাজারে রং-বেরঙের ছোট ছোট বইয়ের কদর ছিল আকাশচুম্বী।
নব্বই দশকের আগে থেকেই দেশের প্রতিটি জেলা সদর এবং পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন উপজেলা সদরে ডিজিটাল টেলিফোন ব্যবস্থার সুবাদে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপের প্রায় সব দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশের প্রবাসীদের সঙ্গে সরাসরি ফোনে কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি হয়। কিন্তু মিনিটে স্থানভেদে একশ’ থেকে দেড়শ’ টাকা করে বিল আসায় নিতান্ত অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ টেলিফোন করতেন না। তাও দু-চার মিনিটের মধ্যেই আলাপ সীমাবদ্ধ থাকত। দীর্ঘ আলাপ হলে রিভার্স কল করা হতো যাতে প্রবাসীকে কল ব্যাকের মেসেজ দেয়া হতো, কল এলে রিভার্স কলের বিল দেয়া হতো। এছাড়া এরও আগে অতি জরুরি খবর পৌঁছানোর জন্য টেলিগ্রামের প্রচলন ছিল।
বর্তমানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে স্বল্প খরচে চ্যাটিং করা যায় এবং উভয় উভয়ের আলাপ সরাসরি শোনার পাশাপাশি দেখতেও পারে ওয়েব ক্যামেরার মাধ্যমে মনিটরের পর্দায়। ফেসবুকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাতচিত করা যায়। চার-পাঁচ টাকা মিনিটে আমেরিকা, কানাডা ও ইউরোপের প্রায় সব দেশেই ফোন করা যায়। নেট কলিং কার্ড মোবাইলে ঢুকিয়ে নিজ মোবাইলের মাধ্যমে স্বল্প মূল্যে আলাপ করা যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এছাড়া মোবাইলের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কলচার্জ ব্যাপকভাবে হ্রাস পাওয়ায় অনেকেই নিজের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সরাসরি ফোন করে ভাবের আদান-প্রদান করেন হরহামেশাই। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রবাসীরা বিদেশ থেকে ইন্টারনেট কার্ডের মাধ্যমে দেশে স্বজনদের মোবাইলে বা ফোনে আলাপ করেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
হাল জামানায় যাদের বাড়িতে আইএসডি টেলিফোন সংযোগ নেই তাদেরও কোনো ভাবনা নেই। স্বল্প মূল্যে পাওয়া যায় আইএসডি মোবাইলের সিম। অথবা দেশের যে কোনো মোবাইল থেকে প্রবাসীর কাছে মুহূর্তে এসএমএস পাঠানো যায় ‘প্লিজ কল ব্যাক’। তখন প্রবাসীরা সঙ্গে সঙ্গে অথবা সময়-সুযোগ মতো কল ব্যাক করেন। প্রবাসীরা বর্তমানে দেশে রেমিটেন্সও পাঠাতে পারেন মুহূর্তে। মোবাইল ফোনে জানিয়ে দেন টাকা পাঠানোর খবর ও পিন নম্বর। মুহূর্তে ব্যাংকে গিয়ে টাকা তুলে আনা যায় অনায়াসে। এছাড়া মোবাইল রেমিটেন্স তো আছেই। আগের যুগে বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে গেলে পাত্রী চিঠিপত্র লিখতে পারে কিনা যাচাই করা হতো এমনকি হাতের লেখাও দেখা হতো সুন্দর কি না। বর্তমান ডিজিটাল যুগে কনে কম্পিউটারে কতটুকু পারদর্শী তা জানার রেওয়াজ এসে গেছে। চিঠি লেখার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায় না লিখে লিখে অনেকেরই হাতের লেখা বসে যাচ্ছে অথবা হাতের লেখা ঝালাই দিতে পারছেন না। আর ডিজিটাল এ যুগে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে চিঠি লেখার অভ্যাস। প্রয়াত কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর লেখা জনপ্রিয় গান ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো এখন আর তেমন একটা গাইতে শোনা যায় না।
লেখক: সাংবাদিক ও অধ্যয়ণরত মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (সাংবাদিকতা ও গণসংযোগ বিভাগ)।