আনারুল ইসলাম খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাপ্লাইড ম্যাথে মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। অনার্সেও গণিতে প্রথম শ্রেণীপ্রাপ্ত তিনি। প্রথম শ্রেণী রয়েছে এসএসসি ও এইচসিতেও । মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়ায় স্বর্ণপদক লাভ করেন তিনি।
আনারুল ইসলাম বর্তমানে চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার খোন্দা কামাল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন বিনা বেতনে।
আনারুল ইসলামের মত রুহুল আমিন নামে আরেক মেধাবী শিক্ষক বিনা বেতনে শিক্ষকতা করছেন রাজশাহীর গোদাগাড়ি মালকামলা উচ্চ বিদ্যালয়ে। রুহুল আমিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাপ্লাইড ম্যাথে অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীপ্রাপ্ত। এ ছাড়া এসএসসি ও এইচএসসিতেও প্রথম শ্রেণী রয়েছে তার।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাল ফল করেও কেন বেসরকারি হাইস্কুলে বিনা বেতনে চাকরি করছেন জানতে চাইলে আনারুল ইসলাম বলেন, ২০১৫ সালে তিনি শিক্ষকতায় যোগ দেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেকায়েপ প্রকল্পের অধীনে গৃহীত তিন বছর মেয়াদী অতিরিক্ত শ্রেণী শিক্ষক বা এসিটি হিসেবে। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল মেধাবীদের শিক্ষতায় আগ্রহী করা। ফলে এ প্রকল্পের অধীনে সারা দেশে মেধাবীরা শিক্ষকতায় যোগ দেন মডেল শিক্ষক হিসেবে। প্রকল্পের ম্যানুয়েল লেখা রয়েছে প্রকল্প শেষে এসব মডেল শিক্ষকদের চাকরি স্থায়ী করা হবে। প্রকল্প চলাকালে শিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে অসংখ্যবার আমাদের আশ্বাস দেয়া হয়েছে আমাদের চাকরি স্থায়ী করা হবে। এমনকি ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার পরও আমাদের বারবার বলা হয়েছে আমাদের চাকরি স্থায়ী করা হবে। এমনকি গত বছর ১৮ নভেম্বর আন্ত:মন্ত্রণালয় বৈঠকেও আমাদের চাকরি পরবর্তী প্রকল্পে স্থানান্তরের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।
আনারুল বলেন, প্রথমত চাকরি স্থায়ীকরণের আশ্বাসে শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছিলাম। এরপর চাকরি করা অবস্থায় এবং প্রকল্প মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার পরও জোরালো আশ্বাসের কারনে এখনো শিক্ষকতা করে যাচ্ছি। গত বছর ১৭ ডিসেম্বর প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার পর আমাদের বেতন বন্ধ হয়ে গেছে। বেতন বন্ধ হয়ে যাবার পরও আমাদের চাকরি স্থায়ীকরণ বিষয়ে এত আশ্বাস দেয়া হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে যে, আমরা বিনা বেতনে গত ১৩ মাস ধরে শিক্ষকতা করে যাচ্ছি। কিন্তু সর্বশেষ শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকে আমাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে আমাদের চাকরি স্থায়ী করা হবে না। এমনকি পরবর্তী কোনো প্রকল্পেও রাখা যাবে না।
ফলে আনারুল ইসলাম ও রহুল আমিনের মত সেকায়েপ প্রকল্পের বঞ্চিত ৫ হাজার ২শ এসিটি মডেল শিক্ষকেরা রোববার থেকে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচী শুরু করেছেন।
কর্মসূচীতে যোগ দেয়া এসব মডেল শিক্ষকদের অনেকে রয়েছেন বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা। অনেকে নামকরা সরকারি কলেজ থেকে অনার্স মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীপ্রাপ্ত।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা রুহুল আমিন বলেন, পেশাটাকে ভালবেসে শিক্ষকতার কাজে এতই মগ্ন ছিলাম যে বুঝতে পারিনি কখন সময় শেষ হয়ে গেল। প্রকল্পে চাকরি করে এখন সরকারি চাকরির বয়সও শেষ হয়ে গেছে।
চাকরির শর্ত অনুসারে আমরা কোনো কোচিং প্রাইভেট পড়াইনি এখনো পড়াচ্ছি না। বিনা বেতনে শিক্ষকতা করে যাচ্ছি ১৩ মাস ধরে। আমার এক ছেলে রয়েছে। বাবার উপার্জনে সংসার চালাচ্ছি। পরিবারের সবার কাছে খুবই বিব্রতকার অবস্থায় রয়েছি। এত ভাল ফল করেও এখন বেতন ছাড়া চাকরি করতে হচ্ছে এটা কেউ মেনে নিতে পারছে না। কেউ ভাল চোখে দেখছে না। আত্মীয় স্বজন বলছে কি পড়ালেখা করেছ তোমরা । চাকরি কর বেতন পাওনা। তোমার চেয়ে কম মেধাবী কত ছেলে মেয়ে কত ভাল ভাল চাকরি করছে উচ্চ বেতনে।
আনারুল ইসলাম তার মোবাইল থেকে ছেলের ছবি দেখিয়ে বলেন, বিয়ে করেছি। ১ ছেলে আছে আমার। বেতন নেই। সরকারি চাকরির বয়সও শেষ হয়ে গেছে। আশায় আশায় থাকতে থাকতে এতদূর চলে এসেছি। এখন যদি কর্তৃপক্ষ আমাদের চাকরি স্থায়ী না করে তাহলে আমাদের জীবন ধ্বংস হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো গতি নেই।
আনারুল ইসলাম, রুহুল আমিনের মত কর্মসূচীতে যোগ দেয়া অনেক শিক্ষক জানান, নিয়মিত ক্লাস নেয়ার পাশপাশি প্রতি সপ্তাহে ১৬ থেকে ২০টি অতিরিক্ত ক্লাস নিতে হতো তাদের। স্কুলের নিয়মিত ক্লাসের আগে ও পরে অতিরিক্ত ক্লাস হতো। এতে তারা সবাই সারা বছর এত ব্যস্ত থাকতেন যে, অনেকেই অন্য কোনো চাকরির জন্য চেষ্টার কোনো সময়ই পাননি। তা ছাড়া সবার আশা ছিল চাকরি স্থায়ী হবে। ফলে অনেকে সে কারনেও অন্য চেষ্টা করেনি। মন্ত্রণালয় থেকে এভাবে আশ্বাস না দিয়ে যদি সময় মত বলে দিত চাকরি স্থাীয় হবে না এবং অন্য প্রকল্পেও নেয়া যাবে না তাহলে তারা বিকল্প চিন্তা করতে পারতেন। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার প্রায় এক বছর পরও তাদের আশ্বাস দেয়া হয়েছে স্থায়ীকরনের আর ক্লাস চালিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর এখন অনেকের সরকারি চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাবার পর বলা হচ্ছে চাকরি স্থায়ী করা হবে না।
কর্মসূচীতে যোগ দেয়া রকিবুল হাসান নামে একজন শিক্ষক বলেন, পত্রিকায় চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে বলা হয়েছিল আপনি কি মডেল শিক্ষক হতে চান? তাহলে সেকায়েপ প্রকল্পের অধীনে শিক্ষকতায় যোগ দিন।
রকিবুল বলেন, মডেল শিক্ষক হবার আশায় শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের সাথে এমনটি করা হবে তা কল্পনাও করতে পারিনি। প্রকল্প শেষে আমি অনেক বার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে মন্ত্রনালয়ের সংশ্লিষ্ট উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেছি। প্রতিবারই আমাকে তারা বলেছেন, তোমাদের চাকরি তো স্থায়ী হয়ে যাচ্ছে এটা নিশ্চিত।
রকিবুল বলেন, নিয়মিত ক্লাসের পাশাপাশি এত পরিমান অতিরিক্ত ক্লাস নিতাম যে, একবার পড়াতে পড়াতে আমি বেহুশ হয়ে যাই। এভাবে আমাদের পড়ানোর কারনে স্কুলের ফলাফলের আশাতীত উন্নতি হয়। বর্তমানে চাকরির জন্য যে প্রতিযোগিতা এবং সেজন্য যে ধরনের প্রস্তুতি নিতে হয় তার কোনো সুযোগ এসিটি শিক্ষকদের ছিল না।
-সময়ের সংলাপ২৪/ডি-এইচ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন