আজ ১৩ মে, টাঙ্গাইলে টর্নেডোর ভয়াবহ ছোঁবলের ২২তম বার্ষিকী। দিনটি জেলার ৫ উপজেলাবাসীর কাছে শোক ও আতঙ্কের দিন। ২২ বছর আগে ১৯৯৬ সালের এই দিনে ২-৩ মিনিট স্থায়ী টর্নেডোর ছোঁবলে গোপালপুর, কালিহাতী, বাসাইল, ঘাটাইল এবং সখীপুর উপজেলার ৫২৩ জন নারী-পুরুষ নিহত হন। আহত হন আরও অন্তত ৩০ হাজার জন। এছাড়া ৮৫ হাজার ঘরবাড়ি, ৮৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ১৭টি মসজিদ এবং ১৪টি মন্দির লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। সে ঘটনা মনে হলে এখনও শিওরে ওঠেন ভুক্তভোগি পরিবারের সদস্যরা।
সেদিন বিকেলে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে মুহূর্তের মধ্যে জেলার ৫ উপজেলার ৪০টি গ্রাম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। অনেকের ঘরের চাল উড়ে যাওয়াসহ গোলার ধান পর্যন্ত ঝড়ে অদৃশ্য হতে দেখা যায়। অনেক ঘরবাড়ি, গাছপালা, গবাদিপশু নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। অনেক নারী-পুরুষের পরনের কাপড় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। অনেককে সম্পূর্ণ বস্ত্রহীন ক্ষতবিক্ষত দেহে বিভিন্ন কৃষি জমি, জঙ্গল, পুকুর-ডোবা থেকে উদ্ধার করা হয়। বৈদ্যুতিক খুঁটি ও নলকূপের উপরের অংশ, দালানের ছাদ পর্যন্ত উঠে যায়।
১৯৯৬ সালের ১৩ মে ছিল সোমবার। বিকেল ৪টা ১৭ মিনিটের দিকে আকস্মিকভাবে গোপালপুর উপজেলার হেমনগর ইউনিয়নের বেলুয়া গ্রাম থেকে শুরু হওয়া ২-৩ মিনিট স্থায়ী প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় (টর্ণেডো) আলমনগর ইউনিয়ন হয়ে মির্জাপুর ইউনিয়নের পশ্চিম নুডুরচর গ্রামে শেষ হয়। মাত্র দুই মিনিটের তাণ্ডবে গোপালপুর উপজেলার ১৬টি গ্রাম লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়, নিহত হন ১০৪ জন। এছাড়া চার হাজারেরও বেশি গ্রামবাসী আহত হন। ঝড়ে ২০০ একর বোরো জমির পাকা ধান নষ্ট হয়ে যায়। ১০ হাজার গৃহপালিত পশু-পাখি মারা যায়। ওইদিনই বিকেল সোয়া ৫টার দিকে কালিহাতী উপজেলার তাঁতসমৃদ্ধ এলাকা রামপুর এবং কুকরাইল গ্রামে হানা দেয় টর্ণেডো। রামপুর ও কুকরাইল গ্রামের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ৩-৪ মিনিটের প্রলয়ঙ্করী ঘুর্ণিঝড়ে ওই দুই গ্রামের একই পরিবারের ৭ জনসহ ১০৫ নারী-পুরুষ ও শিশু নিহত এবং চার শতাধিক মানুষ আহত হয়। রামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে গণকবরে একত্রে দাফন করা হয় ৭৭ জনকে।
বাসাইলের মিরিকপুরে ধান কাটার মৌসুম থাকায় উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলার ধানকাটা শ্রমিক জড়ো হয়েছিল এ অঞ্চলে। ঝড় থেকে রক্ষা পেতে মিরিকপুর-সৈদামপুরের ধানের মাঠের আতঙ্কগ্রস্ত বহু শ্রমিক মিরিকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের দালানে আশ্রয় নিয়েছিল। সেদিন বিকেল ৫টা ২০ মিনিটের দিকে উত্তর দিক থেকে ধেয়ে আসা ৩-৪ মিনিটের টর্ণেডোর ছোঁবলে দালান বিধ্বস্ত হওয়ায় তারা সেখানেই চাপা পড়ে মারা যায়। এলাকার গ্রামের বহু লোক নিখোঁজ হয়। পরদিন তাদের মৃতদেহের খোঁজ মেলে পার্শ্ববর্তী নদী, পুকুর, খাল ও বিলে। মৃত মানুষ, গবাদিপশু ও মাছের দুর্গন্ধে বাসাইলের বাতাস ভারি হয়ে যায়।
সেদিন মিরিকপুর ছাড়াও উপজেলার বর্নীকিশোরী, হান্দুলিপাড়া, কলিয়া, কাউলজানী, খাটরা, ফুলকী, বাদিয়াজান, সুন্না গ্রামের অংশবিশেষ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্নীকিশোরী উত্তরপাড়ার একই পরিবারের কয়েক জনের মৃতদেহ প্রায় আধমাইল দূরের বিল থেকে উদ্ধার করা হয়। অনেক পরিবারের কেউ জীবিত ছিল না। বাসাইল উপজেলা হাসপাতালসহ পার্শ্ববর্তী হাসপাতালগুলো ছিন্নভিন্ন আহত লোকজনে পরিপূর্ণ হয়ে যায়।
টর্ণেডো আক্রান্ত এলাকায় একাধিক স্থানে নিহতদেরকে গণকবর দেয়া হয়। ঘূর্ণিঝড়ে বাসাইল উপজেলার ১৭ গ্রামের প্রায় সাড়ে ২৫ হাজার লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ৩ হাজার ঘরবাড়ি। ২০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ৫-৬টি কাঁচাবাজার, প্রায় ২ হাজার গবাদিপশু, ১০ হাজার হাঁস-মুরগি, সাড়ে ৩০০ টিউবওয়েল ও ২৫ হাজার গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সরকারি হিসেবে সেই প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৃতের সংখা ২৩৭ জন। তবে বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা ছিল আরও অনেক বেশি। সে ঘটনার পর থেকে আজও কালো মেঘের আনাগোনা দেখলে বাসাইলের মানুষের মনে ভেসে ওঠে মিরিকপুরের সেই ঝড়ের স্মৃতি।
টর্ণেডোয় প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের স্মরণ করতে স্ব স্ব এলাকায় স্থানীয় সামাজিক সংগঠনগুলোর উদ্যোগে প্রতিবছর দোয়া ও মিলাদ মাহফিল, মসজিদে মসজিদে তোবারক বিতরণ, প্রার্থণা এবং স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। এ বছরও বাসাইলের মিরিকপুর, কালিহাতীর রামপুর, গোপালপুরের আলমনগর গ্রামে অনুরূপ কর্মসূচি নেয়া হয়েছে।
-সময়ের সংলাপ২৪/ডি-এইচ