মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখতে জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলের পূর্বনির্ধারিত সফর বাতিল করেছে দেশটির সরকার। হঠাৎ করেই কোনো কারণ উল্লেখ না করে সফর বাতিল করে দেশটির কর্তৃপক্ষ।
ইয়াংগুনে জাতিসংঘ মুখপাত্র স্তানিস্লাভ সেলিঙ এ তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, এই সফর বাতিল করার পেছনে কোনো কারণ দেখায়নি সরকার।
এদিকে রয়টার্স-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর গণহত্যা আর ভয়ঙ্কর নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা। তবে যারা রাখাইন রাজ্য থেকে পালাতে পারেনি তাদের বনজঙ্গলে লুকিয়ে থেকে পানি আর ঘাস খেয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। প্রতিদিন সকালে সেনাবাহিনীরা রাখাইনের গ্রামগুলোতে আসে। তারা গ্রামে এলে জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ে মুসলিম রোহিঙ্গারা এবং আর সেনা চলে গেলে তারা রাতে আবার বাড়িতে ফিরে আসেন।
ওই গ্রামের একজন শিক্ষক জানান, ৮০০টি পরিবারের মধ্যে এখন মাত্র ১০০টি পরিবার রয়েছে। বর্তমানে তারা জঙ্গলের কাছাকাছি আছেন। তবে তাদের কাছে খাওয়ার মতো কিছুই নেই। উপায় না পেয়ে জঙ্গলে অনেক ঘাস থাকায় তারা ক্ষুধা পেলে ঘাসই খান। এরপর পানি সংগ্রহ করে পান করেন। এভাবেই বেঁচে আছেন তারা।
তবে ওই শিক্ষকের নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ করেনি বার্তা সংস্থাটি।
গত ২৪ আগস্ট রাতে সহিংসতার পর থেকে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত চার লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। তবে পালিয়ে আসার হার আগের চেয়ে কিছুটা কমলেও, তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে বলার সময় এখনও হয়নি জানান সংস্থাটির মুখপাত্র।
অভিযানের নামে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী খুন, ধর্ষণ, ঘরবাড়ি পুরিয়ে দেওয়া, কুপিয়ে হত্যাসহ বর্বরতার চূড়ান্ত সীমাও অতিক্রম করেছে বলে অভিযোগ নিউইয়র্ক ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইচ ওয়াচের। স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবি বিশ্লেষণের মাধ্যমে সংস্থাটি বলেছে, ইতোমধ্যে প্রায় ২১৪টি রোহিঙ্গা অধুষ্যিত গ্রাম পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী মানবতাবিরোধী অপরাধ করছে। তাই দেশটির ওপর কিছু ক্ষেত্রে ও তার সেনাবাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানায় সংস্থাটি।
এছাড়া মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর এ নির্মম নির্যাতন-নিপীড়নকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ।
তবে এসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে মিয়ানমার সরকার। ১৯ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অং সান সুচি বলেন, ৫ সেপ্টেম্বরের পর থেকে রাখাইনে কোনো ধরনের সহিংসতা বা অভিযান চালানো হয়নি। অধিকাংশ রাখাইন গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে যেসব খবর অন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এসেছে, সেটিও অস্বীকার করে তিনি বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পর্যবেক্ষণে ভীত নয় মিয়ানমার।’
‘বেশ কিছু মুসলিম বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে, এ ধরনের খবর শুনে আমরা উদ্বিগ্ন। রাখাইন থেকে মুসলিমরা কেন পালিয়ে বাংলাদেশে যাচ্ছে, তা খুঁজে বের করতে চাই। অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ আছে। তাদের সব কথাই শুনতে হবে। কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার আগে অভিযোগগুলো যে তথ্য-প্রমাণনির্ভর, তা নিশ্চিত করতে হবে’, বলেন সুচি।
আর পরিপ্রেক্ষিতেই রোহিঙ্গা মুসলমানরা কেন পালাতে বাধ্য হয়েছে জাতিসংঘ সেটা রাখাইনে গিয়ে তদন্ত করার জন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ দিয়ে আসছিল। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই তা বাতিল করে দিল সুচি নেতৃত্বাধীন 'ডি-ফ্যাক্টো' সরকার।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে দেশটির সেনাবাহিনীর হাতে নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আসা ৭ লাখ রোহিঙ্গাকে খাদ্য সহায়তা দেবে জাতিসংঘ। ২৭ সেপ্টেম্বর বুধবার জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) একজন কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এএফপি-কে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ডব্লিউএফপি’র বাংলাদেশ শাখার উপপ্রধান দীপায়ন ভট্টাচার্য বলেন, ‘বর্তমানে সাত লাখ আশ্রয়প্রার্থীর জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছে জাতিসংঘ। যদি আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা সাত লাখেও পৌঁছায় তাহলে আমরা তাদের সবাইকে সহায়তা করতে পারব। আসন্ন সপ্তাহগুলোতেও যদি উদ্বাস্তুদের আগমন অব্যাহত থাকে তা বিবেচনা করে ব্যাপক খাদ্য ও অন্য জরুরি সহায়তা দেওয়ার জন্য আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রাখছি।’
অন্যদিকে, রাখাইনে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত পুড়ে যাওয়া গ্রামগুলো দখলে নিতে যাচ্ছে মিয়ানমার সরকার। ২৬ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার এক বৈঠকে এমনটাই জানিয়েছেন দেশটির সমাজ কল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী উইন মিয়াত আইয়ে। দেশটির সরকারি দৈনিক ‘নিউ লাইট অব মিয়ানমার’-এর বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ খবর প্রকাশ করেছে।
বৈঠকে সমাজ কল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী পুড়ে যাওয়া ভূমি সরকারের দখলে চলে যায়। সরকার সেইসব ভূমির পুনঃউন্নয়ন করবে।’
দেশটিতে প্রচলিত একটি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনের বরাত দিয়ে মন্ত্রী আরও বলেন, ‘ভূমি পুনঃউন্নয়ন কাজ খুবই কার্যকর হবে।’ তবে মিয়ানমার সরকারের পুনঃউন্নয়ন পরিকল্পনা আসলে কী, সে বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা তিনি দেননি।
সহিংসতা থেকে প্রাণ বাঁচাতে দেশত্যাগ করা রোহিঙ্গা মুসলিমরা যদি দেশে ফিরে যায় তবে তাদের নিজ নিজ গ্রামে প্রবেশ এবং সম্পত্তির দখল নিতে দেওয়া হবে কি না, সে বিষয়েও কিছু জানাননি তিনি।
এদিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান নির্যাতন বন্ধে করণীয় ঠিক করতে আজ আবারও বৈঠকে বসছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। বাংলাদেশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য না হলেও এতে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি সরকারের বক্তব্য তুলে ধরবেন বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী। জাতিসংঘের ৭২তম সাধারণ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া ভাষণে পাঁচ দফা প্রস্তাবের ভিত্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরা হবে বলে জানান তিনি। -সময়ের সংলাপ24/ডি-এইচ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন