নবান্ন উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। অগ্রহায়ণের শুরুতেই এপার বাংলা ও ওপার বাংলাতে চলে উৎসবের নানা আয়োজন। নতুন ধান কাটা আর সেই ধানের প্রথম অন্ন খাওয়াকে কেন্দ্র করে পালিত হয় নবান্ন উৎসব। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। এ যেন সত্যি হৃদয়ের বন্ধনকে আরও গাঢ় করার উৎসব। হেমন্ত এলেই দিগন্তজোড়া প্রকৃতি ছেয়ে যায় হলুদ-সবুজ রঙে। এই শোভা দেখে কৃষকের মন আনন্দে ভাসতে থাকে। কারণ, কৃষকের ঘর ভরে উঠবে গোলা ভরা ধানে। বছর ঘুরে আবার এসেছে অগ্রহায়ণ। বাঙালির প্রধান কৃষিজ ফল কাটার ক্ষণ। স্মরণাতীত কাল থেকে বাঙালির জীবনে পয়লা অগ্রহায়ণকে বলা হয়ে থাকে বাৎসরিক সুদিন। এদিনকে বলা হয় নবান্ন। নবান্ন হচ্ছে হেমন্তের প্রাণ। নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি করা হয় পিঠা, পায়েস, ক্ষীরসহ হরেক রকমের খাবার; বাড়ির আঙিনা নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধে ভরে ওঠে।
সোনালি ধানের প্রাচুর্য আর বাঙালি সংস্কৃতির বিশেষ অংশ নবান্নকে প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ধরা পড়েছে দারুণভাবে। তিনি লিখেছেন, ‘চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল/ তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল,/ প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে-থেকে আসিতেছে ভেসে/ পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাড়ারের দেশে।’ পুনর্বার ফিরে আসার আকুতি ধ্বনিত হয়েছে জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতায়, ‘আবার আসিব ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়/ হয়তো মানুষ নয় হয়তো শঙ্খচিল শালিখের বেশে;/ হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে’। প্রকৃতির বিচিত্র এ রূপের বর্ণনা দিয়েছেন এ দেশের সব কবি-সাহিত্যিক। কুয়াশায় আচ্ছন্ন চারদিক আর কৃষকের গোলায় উঠছে পাকা ধান। চিরায়ত বাংলার চিরচেনা রূপ এটি। কৃষকের মাঠে এখন সোনারঙা ধানের ছড়াছড়ি। সারা দেশেই আমন ধান কাটার উৎসব শুরু হয়ে গেছে। কৃষক রাশি রাশি ভারা ভারা সোনার ধান কেটে নিয়ে আসে ঘরে। ধান ভাঙার গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে, ঢেঁকির তালে মুখর হয় বাড়ির আঙিনা। অবশ্য যান্ত্রিকতার ছোঁয়ায় এখন আর ঢেঁকির তালে মুখরিত হয় না। তার পরও নতুন চালের ভাত নানা ব্যঞ্জনে মুখে দেওয়া হয় আনন্দঘন পরিবেশে। তৈরি হবে নতুন চালের পিঠা, ক্ষীর-পায়েস। কৃষক-কৃষাণীরা নবান্নের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেবেন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে নবান্নে বাড়ির জামাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়। মেয়েকেও বাপের বাড়িতে ‘নাইয়র’ আনা হয়। নবান্ন আর পিঠেপুলির উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা হয় সবাই। তাই অগ্রহায়ণ এলেই সর্বত্র ধ্বনিত হয়, ‘আজ নতুন ধানে হবে রে নবান্ন সবার ঘরে ঘরে…।’ নতুন ধানের ভাত মুখে দেওয়ার আগে মিলাদ পড়ানো হয়। মসজিদে শিন্নি দেওয়ার রেওয়াজও আছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের কৃষকের ঘরে পূজার আয়োজনও চলে।
নবান্নের শাব্দিক অর্থের দিকে আমার যাওয়ার ইচ্ছে নেই। তার পরও এক কথায় বলতে পারি, ‘নবান্ন’ শব্দের অর্থ ‘নতুন অন্ন’। নবান্ন ঋতুকেন্দ্রিক একটি উৎসব। হেমন্তে নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় এই উৎসব পালন করা হয়। এই উৎসব পালিত হয় অগ্রহায়ণ মাসে। অগ্র অর্থ ‘প্রথম’। আর ‘হায়ণ’ অর্থ ‘মাস’। এ থেকে সহজেই ধারণা করা হয়, একসময় অগ্রহায়ণ মাসই ছিল বাংলা বছরের প্রথম মাস। হাজার বছরের পুরোনো এই উৎসব সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক, সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী এবং সবচেয়ে প্রাচীনতম মাটির সঙ্গে চিরবন্ধনযুক্ত।
নবান্নের প্রাণ গ্রামীণ মেলা
নবান্ন উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আয়োজন হলো মেলা। হরেক রকমের দোকান নিয়ে বসে গ্রামীণ মেলা। তবে গ্রামীণ মেলা এখন আর শুধু গ্রামেই হয় না; শহরেও ব্যাপকভাবে আয়োজিত হয়। এই মেলায় পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের পিঠা, মিষ্টি, সন্দেশ, মন্ডা-মিঠাই, খেলনা-পুতুল, মাটির জিনিসপত্র আর বসে বাউল গানের আসর। নবান্ন উৎসবকে ঘিরে গ্রাম-গঞ্জে সব শ্রেণীর মানুষের ঢল নামে। নাচ আর গানে মুখরিত হয় মেলাপ্রাঙ্গণ। প্রকৃতি আর পরিবেশের মধ্যে আত্মহারা হয়ে ওঠে বাঙালিমানস।
নগরেও নবান্ন উৎসব
‘এসো মিলি সবে নবান্নের উৎসবে’ এই স্লোগান সামনে রেখে প্রতিবছরের মতো এবারও নগরে নবান্ন উৎসব পালিত হয়েছে। এই সময়ে কৃষকের ঘরে নতুন ফসল আসে, সোনালি ফসলে ভরে ওঠে কৃষকের গোলা। ঘরে থাকে খুশির আমেজ, আর সেই খুশির বহিঃপ্রকাশ ঘটে নবান্ন উৎসবের মাধ্যমে। রাজধানীর শাহবাগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে ও বকুলতলায় প্রতিবছর নবান্ন উৎসব উদ্যাপিত হলেও এ বছর কর্তৃপক্ষের অনুমতি না পাওয়ায় এবার রমনার বটমূলে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়। উৎসবে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি, বাউলগান, আদিবাসীদের পরিবেশনা ও নবান্নকথন। এ ছাড়া ঐতিহ্যবাহী নানা রকম পিঠা প্রদর্শনী সকাল থেকে বিরতিহীনভাবে চলবে। উৎসবে প্রায় ৩৫টি সংগঠনের প্রায় ৩০০ শিল্পীসহ প্রায় চার শতাধিক শিল্পী সংগীত, নৃত্য ও আবৃত্তি পরিবেশন করেন।
বলতে গেলে অগ্রহায়ণের প্রথম সকালে নবান্ন উৎসবে মেতে ওঠে রাজধানীবাসী। নানা শিল্পীদের কণ্ঠে আনন্দে মাতিয়ে তুলেছিল রমনা বটমূল। আবহমান কাল থেকে নবান্নের এ শুভক্ষণে উৎসব-আনন্দে পূজা-পার্বণে মেতে ওঠে বাঙালি। শিল্পায়ন ও নগরায়ণের কশাঘাতে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামবাংলার আনন্দময় সরল জীবন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তরুণ প্রজন্মের ওপর পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রবল প্রভাব। তবু নাগরিক জীবনে নবান্নের শুভক্ষণের শুভ ছায়া ছড়িয়ে দিতে অগ্রহায়ণের প্রথম দিনে আয়োজন করা হয়েছিল নবান্ন উৎসবের। হেমন্তের মিষ্টি রোদ যখন চারদিক নিজের আলোর রোশনাই ছড়িয়ে দিচ্ছিল, ঠিক সেই সময় রমনা উদ্যানের বিশাল অশ্বত্থগাছের নিচ থেকে, যা রমনা বটমূল বলেই বেশি পরিচিত, সেখান থেকে ভেসে আসে বাঁশির সুমধুর সুর। উৎসবের উদ্বোধন করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। উৎসব উদ্বোধন করে বিচারপতি হাবিবুর রহমান বলেন, ‘গ্রামে যে নবান্ন উৎসব করা হয়, সেটাই প্রধান ও আসল নবান্ন উৎসব। যেখানে আমরা নতুন ধানকে স্পর্শ করতে পারি। খেতে পারি নানা রকম মুখরোচক পিঠা। সে হিসেবে শহুরে জীবনে যে নবান্ন উৎসব করা হয়, সেটা তো প্রতীকী। আমরা যাতে আমাদের উৎসকে ভুলে না যাই সে জন্যই এ আয়োজন।’
বাঁশির সুরমূর্ছনা শেষ হতে না হতেই মঞ্চ মাতায় ধ্রুব শিশু-কিশোর সংগঠন। খুদে কণ্ঠে এক সুরে গেয়ে ওঠে, ‘এ কি অপরূপ রূপে মা তোমার হেরিনু পল্লীজননী’। গানের পরিবেশনা শেষ হতেই আসে কবিতার পালা। কবিতা শেষে এবার নাচের পালা। ‘কান্নাহাসির দোল-দোলানো পৌষ ফাগুনের পালা’ গানের সঙ্গে নূপুরের ঝংকার তোলেন নৃত্যশ্রীর শিল্পীরা। নাচ শেষে আবারো গানের পালা। বহ্নিশিখার শিল্পীরা গেয়ে শোনায়, ‘নাও ছাইড়া দে রে মাঝি/ পাল উড়াইয়া দে।’ এ গান শেষে পরিবেশিত হয় নজরুলের নানা গান। এ ছাড়া বিভিন্ন শিল্পীগোষ্ঠীর পরিবেশনায় মেতে ওঠে গোটা রমনা বটমূল প্রাঙ্গণ। এরপর বের করা হয় নবান্ন শোভাযাত্রা। রমনা বটমূল থেকে বের হয়ে রমনার পাশের রাস্তা ধরে কিছুটা পথ ঘুরে আবার বটমূলেই শেষ হয়। এরপর বিকালে উৎসবের দ্বিতীয় পর্বে ঢাকঢোল, বাউলগান, লাঠিখেলা, নৃত্য ও সংগীতের মনোমুগ্ধকর পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় শহরের নবান্ন উৎসব। এদিকে, উৎসব উপলক্ষে গোটা বটমূল ও এর সংলগ্ন এলাকাকে সাজানো হয় গ্রামীণ আদলে। সেখানে ছিল বাঙালিয়ানারও ছাপ। ছেলেদের পরনে ছিল পায়জামা-পাঞ্জাবি। মেয়েদের পরনে এক প্যাঁচে পরা একরঙা বা চেকের তাঁতের শাড়ি। উৎসবে দিনভর ছিল নানা বয়সী মানুষের উপচে পড়া ভিড়। সব শ্রেণী-পেশার মানুষের এই মিলনমেলায় এসেছিলেন ভিনদেশিরাও। সব মিলিয়ে তাই অনন্য সাধারণ একটি দিন। এ অসাধারণ দিনকে আরও অসাধারণ করতে আগত সবাই নিই নব অঙ্গীকার, ‘একটি শান্তিময় দেশ গড়ার’।- সময়ের সংলাপ24/ডি-এইচ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন