মহাসড়কে দানব যে ”দশ পরিবহন” - সময়ের সংলাপ24
DHAKA WEATHER

Post Bottom Ad

demo-image

মহাসড়কে দানব যে ”দশ পরিবহন”

Share This
খুব শীগ্রই আমরা Somoyersonglap24.com ওয়েবসাইট নিয়ে আসছি..

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ভালুকায় এনা পরিবহনের বাসচাপায় মারা যান ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের ছোট ছেলে ডা. মুশফিকুর রহমান শুভ। বেপরোয়া গতির বাসটির নিচে চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। চলতি বছরে একই পরিবহনের অপর একটি বাসচাপায় রাজধানীর খিলক্ষেতে প্রাণ হারায় গাজীপুরের মিলন বেগম, তার মেয়ে লাভলী আক্তারসহ তিনজন।

রাজধানীর খিলক্ষেত আর ভালুকাই নয়, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে গত দুই বছরে শতাধিক সড়ক দুর্ঘটনার হোতা এনা পরিবহনের বাস। ওই পরিবহনের চালকদের বেপরোয়া গতির কারণে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। শুধু ঢাকা-ময়মনসিংহ নয়, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কেও এনা পরিবহনের বাসচালকদের বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর অভিযোগ রয়েছে। ঈদুল আজহার একদিন পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এনা পরিবহনের একটি বাস বরযাত্রীবাহী মাইক্রোবাসকে চাপা দিলে একই পরিবারের সাতজন নিহত হন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মহাসড়কে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বেপরোয়া গতি। এনাসহ আরও ১০টি পরিবহনের চালকরাই বেশি বেপরোয়া। তাদের গাড়িতেই বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে। ব্র্যাকের গবেষণাতেও একই তথ্য মিলেছে। বেপরোয়া গতি আর দুর্ঘটনার কারণে ওই পরিবহনগুলো মহাসড়কের ‘দানব’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

সমকালের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ প্রতিটি মহাসড়কেই এনা পরিবহনের বাসচালকরা বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালান। নিয়ম অনুযায়ী, মহাসড়কে ৮০ কিলোমিটার সর্বোচ্চ গতিতে গাড়ি চালানোর কথা থাকলেও তা উপেক্ষা করে ১০০-১২০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে গাড়ি চালানো হয়। এনার পরই ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে বেপরোয়া গতির পরিবহন হিসেবে পরিচিত পেয়েছে তিশা। তিশার পরই রয়েছে এশিয়া ও প্রাইম পরিবহন। আর ঢাকা-মাওয়া সড়কে ইলিশা পরিবহন। তবে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে এনার পর আছে সি লাইন ও হানিফ পরিবহনের নন এসি বাস। পরিবহন-সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, মহাসড়কে কয়েকশ’ পরিবহনের গাড়ি চলাচল করে। কিন্তু ১০-১২টি পরিবহনের গাড়ির চালকদের বেপরোয়া গতির কারণে প্রতিদিনই কোনো না কোনো মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে।

তবে এনা পরিবহনের মহাব্যবস্থাপক আতিকুল আলম সমকালের কাছে দাবি করে বলেন, সরকারের বেঁধে দেওয়া গতিতেই মহাসড়কে আমাদের বাসগুলো চলাচল করে। ময়মনসিংহ রুটে আমাদের গাড়ি বেশি চলে বলেই মানুষ বেশি অভিযোগ করে। তবে সব চালককে সাধু বলছি না, অনেক চালক আছেন, তারা দ্রুত গতিতে গাড়ি চালান। ওই সব চালককে সাসপেন্ড করার পাশাপাশি মামলাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এদিকে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অ্যাডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেইঞ্জের গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের শীর্ষস্থানীয় পরিবহন নেতাদের গাড়িই বারবার দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। গবেষণার জন্য ২০১৪ সালে এক হাজার ৮১৭টি সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এতে দুই হাজার ৩৫১ জনের প্রাণহানির পাশাপাশি আহত হন পাঁচ হাজার ৪০৮ জন। এর মধ্যে বাস দুর্ঘটনা ছিল ৫৫৪টি। এতে মারা যান ৮৪৭ জন। আহত হন চার হাজার ৭০ জন। চারজনের করা গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসে, ১০টি কোম্পানির বাসই তিন থেকে সর্বোচ্চ ১৯টি দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। বেশি দুর্ঘটনা (১৯ বার) ঘটিয়ে শীর্ষে আছে বিআরটিসির বাস। এরপর আছে শ্যামলী, হানিফ, এনা, সাকুরা ও ঈগল পরিবহনের বাস। আর ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ৭৯৭টির ধরনও বিশেল্গষণ করে ব্র্যাক। এসব দুর্ঘটনায় এক হাজার ৩৪ জনের প্রাণহানি হয়। আহত হন দুই হাজার ৬০ জন। বাস দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৫১টি। তাতে প্রাণ যায় ৩৮২ জনের। এ বছরও সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটায় বিআরটিসির বাস। এর পর রয়েছে আজমেরী, এশিয়া, বিহঙ্গ, পদ্মা লাইন, পারিজাতক ও তুরাগ পরিবহন।

ব্র্যাকের গবেষক দলের সদস্য প্রিসিলা রাজ বলেন, ‘আমরা চারটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করছি। সেখানে দেখেছি ৮-১০টি পরিবহনের বাসই বেশি দুর্ঘটনা ঘটায়। ওই সব পরিবহনের মালিকদের বেশিরভাগই শীর্ষস্থানীয় পরিবহন নেতা।’

সরেজমিন মহাখালী ও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে গিয়ে পরিবহন-সংশ্লিষ্টদের কাছে জানতে চাওয়া হয়- মহাসড়কগুলোয় সবচেয়ে বেশি বেপরোয়া গাড়ি চালায় কোন পরিবহনের চালকরা? অনেকেই প্রথমে জোরেশোরে এনা পরিবহনের নাম উচ্চারণ করেন। এরপর আছে তিশা, এশিয়া, সি লাইন, ইলিশা, প্রাইম ও হানিফ পরিবহন। মদিনা ট্রান্সপোর্টের হেলপার রানা আহম্মেদ কাছে জানতে চাওয়া হয় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বেপোরোয়া পরিবহন কোনটি? এমন প্রশ্ন শুনে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, ‘যার গাড়ি বেপরোয়া তার কথা মুখে আনা যাবে না।’ রানা আরও বলেন, ‘ভাই, সবাই বেপরোয়া। তয় কয়েকটা কোম্পানির গাড়ি রাস্তাকে আকাশ মনে করে। কাউরে পরোয়া করে না। এগো গাড়ি প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটায়।’ অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এনা পরিবহনের মালিক খোন্দকার এনায়েতউল্যাহ। তিনি ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক। সারাদেশেই তার প্রভাব রয়েছে। মালিক শক্তিশালী বলেই তার পরিবহনের চালকরাও কাউকে পাত্তা দেন না। মহাসড়কে বেপরোয়া গাড়ি চালান।

যাত্রাবাড়ীর বউবাজারে কুমিল্লা-কচুয়ায় চলাচলকারী একটি বাসের চালক রাজন মিয়ার সঙ্গে কথা হয়। বেপরোয়া গাড়ির প্রসঙ্গ টানতেই তিনি বলেন, ‘যেসব মালিকের ক্ষমতা আছে, হেগো চালকরাই উল্টাপাল্টা গাড়ি চালায়। কারণ, হেগো কওনের কেউ নেই।’ গত সোমবার দুপুর ১২টায় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, যাত্রাবাড়ী-মাওয়া সড়কের যাত্রাবাড়ীর মুখে ইলিশ, গুনগুন, আপন, বিআরটিসিসহ আরও অনেক কোম্পানির বাস সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে। জানা যায়, মাছের রাজা যেমন ইলিশ, আর ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের রাজাও ইলিশ পরিবহন। ইলিশ পরিবহনটি যাত্রাবাড়ী ছাড়াও গুলিস্তান থেকে ছেড়ে যায়। ইলিশ পরিবহন মালিক ক্ষমতাসীন দলের হওয়ায় চালকরা কাউকে পাত্তা দেন না। গোমতী পরিবহনের কাউন্টার সুপারভাইজার নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ইলিশ পরিবহনের বাসচালকরা খুবই খারাপভাবে গাড়ি চালান। ওদের কারণে ঢাকা-মাওয়া সড়কে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে।

মহাসড়কে চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর জন্য মালিকদের দিকেই অভিযোগের আঙুলি তুলেছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ। তিনি বলেন, ‘প্রচলিত আইন করে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো যাবে না। যেসব কোম্পানির মালিকরা শ্রমিক ইউনিয়ন ও সড়ক পরিবহন সমিতির নেতা, তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হলেও তারা চালকদের নিয়ন্ত্রণ করেন না। ওই সব মালিকের কাছে জীবনের চেয়ে মুনাফাই বড়। তাই শুধু অভিযুক্ত চালককে কারাদণ্ড দিলেই হবে না; মালিককেও জরিমানা দেওয়ার বিধান করতে হবে। মালিকদের জরিমানা ছাড়া দুর্ঘটনা কমানো যাবে না।’

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘চালকদের বেপরোয়া মনোভাব থেকেই সড়কে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে। আমরা দেখেছি, যারা আইনের আওতায় আসে না, কিংবা আইনের আওতায় আনা যায় না সেই মালিকদের গাড়ির চালকরাই বেশি দুর্ঘটনা ঘটান। পরিবহনের মালিকরা যে যত প্রভাবশালী, সেসব পরিবহনের চালক, হেলপারসহ সবাই ততটাই প্রভাবশালী।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের মহাসচিব উসমান আলী বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনার কয়েকটি কারণের মধ্যে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো একটি। তবে কোনো মালিকই চালকদের দ্রুত গতিতে গাড়ি চালাতে বলেন না কিংবা ক্ষমতাও খাটান না। অনেক ক্ষেত্রে মালিকের নাম ভাঙিয়ে কিছু চালক বেফাঁস কথা কিংবা দ্রুত গতিতে চালাতে পারে। একই সংগঠনের দপ্তর সম্পাদক বাদল চৌধুরী বলেন, ‘বেশি ট্রিপ মারার তাড়াহুড়ার কারণে অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে। তবে মালিক এর জন্য দায়ী নন।
Comment Using!!

Pages