যশোরের মনিরামপুর থেকে গত রোববার অপহৃত হয় স্কুলছাত্র তারিফ হোসেন (৯)। মুক্তিপণের জন্য দাবি করা হয় পাঁচ লাখ টাকা। এ নিয়ে মামলা হওয়ার পর পুলিশের উদ্ধার অভিযানের মধ্যে ৯ জানুয়ারি বুধবার ভোরে 'বন্দুকযুদ্ধে' মারা যায় এক অপহরণকারী। তবে শিশু তারিফকে জীবিত উদ্ধার করা যায়নি। মনিরামপুরের সাতনল এলাকার কালভার্টের নিচে পাওয়া যায় তার লাশ। শুধু যশোরের তারিফ নয়, সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভয়ানক নিষ্ঠুরতায় মারা গেছে একাধিক শিশু। একটি ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ঘটছে আরেকটি বীভৎস ঘটনা।
মানবাধিকারকর্মী ও অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন, মাদকের ভয়াবহতা, সামাজিক অবক্ষয়, দ্রুত সুবিচারের সংস্কৃতি চালু না হওয়া এবং অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারায় বীভৎস ও বিকৃত নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে শিশুদের। শিশু সুরক্ষায় রাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট কৌশল না থাকায়, বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায়, পারিবারিক এবং সামাজিক অস্থিরতা ও অসতর্কতায় এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। গত ৫ জানুয়ারি শনিবার পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় দুই বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা চালায় বাড়ির মালিক। এর পর শিশুটিকে তিনতলার বারান্দা থেকে ছুড়ে ফেলে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় এলাকার লোকজন ফুঁসে ওঠে। এর মাত্র একদিন পর ৭ জানুয়ারি ঢাকার ডেমরায় দুই শিশুর ওপরও নেমে আসে বীভৎস নিষ্ঠুরতা। ওই এলাকার কোনাপাড়ায় স্কুলপড়ূয়া পাঁচ বছর বয়সী দুই ছাত্রীকে বাসায় ডেকে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা চালায় দুই প্রতিবেশী। শিশু দুটি চিৎকার করলে তাদের শ্বাসরোধে হত্যা করে খাটের নিচে লুকিয়ে রাখা হয়। একই দিন রাতে ঢাকার তুরাগ এলাকায় ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। এর আগের দিন সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলায় ধর্ষণের পর তৃতীয় শ্রেণির এক স্কুলছাত্রীকে পানিতে ফেলে হত্যা করা হয়।
নতুন বছরের শুরুতেই একের পর এক এমন নিষ্ঠুর ঘটনায় ক্ষুব্ধ ও হতবিহ্বল অভিভাবকরা। অবশ্য পরিসংখ্যান বলছে, আগের বছরগুলোতেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় শিশুদের ওপর এমন বীভৎসতা, পাশবিকতা আর বড়দের হাতে নিষ্ঠুরতার ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) গত বছরের পরিসংখ্যান বিশ্নেষণে দেখা গেছে, মাসে অন্তত ৪০৮ শিশু নানা ধরনের নিষ্ঠুর অপরাধের শিকার হয়। সে হিসেবে দিনে অন্তত ১৪ শিশু নানা নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছে। শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা বলছেন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে তৈরি করা ওই পরিসংখ্যানের বাইরেও শিশু নির্যাতনের অনেক ঘটনা রয়েছে যা লোকচক্ষুর আড়ালেই থাকছে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক বলেন, শিশুদের প্রতি নির্যাতন, নিষ্ঠুরতা বা পাশবিকতার একটি অন্যতম কারণ- অপরাধীরা মনে করছে শিশুদের আত্মনিয়ন্ত্রণ নেই বা অপরাধের শিকার হলেও তারা প্রতিবাদ করতে পারবে না। এ ছাড়া সাইবার প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ ও এর অপব্যবহারে কারও কারও মধ্যে বিকৃত মানসিকতা দেখা দিচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে শিশুদের ওপরে। তিনি বলেন, শিশু সুরক্ষায় রাষ্ট্রীয় কৌশলগুলো নিশ্চিত করতে হবে। অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে।
মানবাধিকার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, নানা কারণে রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারে অস্থিরতা রয়েছে। এই অস্থিরতার মধ্যে অনেকে মাদকাসক্ত হয়ে শিশুর প্রতি নিষ্ঠুর হচ্ছে। শিশুরা ধর্ষণের শিকার হলেও সামাজিক আতঙ্কে অভিভাবকরা মুখ খোলেন না। এর ফলে অপরাধী আরও বেপরোয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত সারাদেশে চার হাজার ৮৯৬ শিশু খুন ও ধর্ষণসহ নানা অপরাধের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৫৬৩ শিশু ধর্ষণের এবং ৯৩ শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। প্রতিবন্ধী শিশুরাও এই পরিস্থিতির বাইরে নেই। গত বছরের প্রথম ১১ মাসে ২৬ প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষিত হয়েছে। ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছে ৯২ শিশু। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫৭ শিশুকে। ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছে ছয় শিশু। এর বাইরেও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৮৭ শিশু। পর্নোগ্রাফীর শিকার হয়েছে ১৪ শিশু।
শিশু অধিকার ফোরাম জানাচ্ছে, ২০১৮ সালে ৩৯৬ জন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে আরও ৯০ শিশুকে। এ ছাড়া ১৪৬ শিশু অপহরণ হয়েছে। অপহরণের পর ১৩৫ শিশুকে উদ্ধার করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অপহরণের পর ২৮ শিশুকে হত্যা করা হয়। নিখোঁজ হয়েছে ২৩৩ শিশু এবং নিখোঁজের পর উদ্ধার হয়েছে ৫১ শিশু।
-সময়ের সংলাপ২৪/ডি-এইচ