স্মৃতির জানালায় একাত্তর - সময়ের সংলাপ24
DHAKA WEATHER

Post Bottom Ad

খুব শীগ্রই আমরা Somoyersonglap24.com ওয়েবসাইট নিয়ে আসছি..

স্মৃতির জানালায় একাত্তর

Share This

জয় বাংলা ধ্বনিতে মুখরিত আকাশ-বাতাস। মানুষ মহাসংকটে, মহাকষ্টে, মহাযাতনায় বুকফাটা আর্তনাদ করে। কিন্তু সেদিনের এ ধ্বনি আর্তনাদ ছিল না, সেটা ছিল বিজয়ের উল্লাসে বুকফাটা নিনাদ। পরানের গহিন ভেতর থেকে উঠে আসা আনন্দের ফল্গুধারা।

১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর, যেদিন বাংলাদেশের মানুষ ৯ মাসের রক্তঝরা যুদ্ধের মাধ্যমে ছিনিয়ে এনেছিলেন মুক্তি। বিজয়ের মহাউল্লাসে বাংলাদেশের মুক্ত আকাশে সগৌরবে উড়িয়েছিলেন লাখো শহীদের রক্তে রাঙা লাশ সূর্যলাঞ্ছিত সবুজ পতাকাটি।

আমি তখন মুক্ত এলাকায়। নভেম্বরের সূচনা থেকেই মুক্তিবাহিনীর মরণপণ প্রতিরোধ ও অভিযানের মুখে ভেঙে পড়তে থাকে পাকি বাহিনীর রক্ষাব্যুহ। দেশের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোয় মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসিক অভিযানে পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করে পিছু হটতে থাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। নির্বিচার হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বিস্ফোরক দিয়ে গুঁড়িয়ে দিতে দিতে তারা পিছু হটতে থাকে রাজধানী ঢাকার দিকে।

একাত্তর সালে আমি ঢাকায় সে সময়কার পূর্ব পাকিস্তানের শীর্ষ প্রচার সংখ্যার দৈনিক সংবাদপত্র ‘পূর্বদেশ’র প্রধান সহ-সম্পাদকের পদে অধিষ্ঠত ছিলাম। পাকিদের গোয়েন্দা নথিতে আমার বিরুদ্ধে অনেকগুলো পৃষ্ঠা সংযোজিত ছিল। পূর্বদেশের মালেক ছিলেন লিয়াকত আলী খানের নেতৃত্বে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রথম মন্ত্রিসভার পররাষ্ট্রমন্ত্রী নোয়াখালীর প্রখ্যাত আইনজীবী হামিদুল হক চৌধুরী। স্বাভাবিকভাবেই তিনি ছিলেন কট্টর পাকিস্তানপন্থী।

মালেক পাকিস্তানের তাঁবেদার হলেও পূর্বদেশের অধিকাংশ সাংবাদিকই ছিলাম বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শে অনুপ্রাণীত এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি পরম আস্থাশীল। তাদের মধ্যে ছিলাম আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী, শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ছোট ভাই এহতেশাম হায়দার চৌধুরী, ফয়েজ আহমেদ, এমআর আখতার মুকুল, কামাল লোহানী, শহীদ আ ন ম গোলাম মোস্তফা, নাজিমুদ্দিন মানিক এবং আমিসহ আরও কয়েকজন। ফলে পূর্বদেশের সম্পাদকীয় নীতিতে আমরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতিফলন ঘটাতে পেরেছিলাম।

যাই হোক, নানা কারণে আমরা ছিলাম পাকিস্তানবাদীদের টার্গেট। যে কারণে ২৫ মার্চের কালরাতে পাকি সেনাদের নির্বিচার হত্যাকাণ্ড থেকে ভাগ্যগুণে রক্ষা পাওয়ার পর আমাদের অনেকেরই অবস্থান হয় পূর্বদেশ তথা পাকিস্তান অবজারভার ভবন। পত্রিকার নাম ‘পাকিস্তান’ অবজারভার, তদুপরি একই ভবন থেকে প্রকাশিত হতো উর্দু পত্রিকা দৈনিক ‘ওয়াতন’ এবং চলচ্চিত্রবিষয়ক সাপ্তাহিক চিত্রালীর উর্দু সংস্করণ। মালেক হামিদুল হক চৌধুরী। অতএব, পাকিদের চোখে ভবনটি তাদেরই খাস তালুক বলে বিবেচিত ছিল- আর আমাদের জন্য অনেকটাই নিরাপদ আস্তানা। সে কারণে ২৫ মার্চের পরবর্তী দিনগুলোয় যারা পূর্বদেশ আফিসে, মানে অবজারভার ভবনে রাত কাটাতাম তাদের মধ্যে ছিলেন এহতেশাম হায়দার চৌধুরী, ফয়েজভাই (ফয়েজ আহমেদ), কামাল লোহানী, মীর নুরুল ইসলাম, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, নাজিমুদ্দিন মানিক। মাঝে মাঝে অবজারভারের মুসা ভাই (এবিএম মুসা), কেজিভাই (কে জি মোস্তফা) ও ইকবাল সোহবান চৌধুরী আর আমাদের সময়কার জুনিয়র সহকর্মী আজমল হোসেন খাদেম ও ফয়েজভাইয়ের ভাগনে চৌধুরী মাজহার। এ ছাড়া সংশোধনী বিভাগ ও ছাপাখানার কয়েকজন কর্মীও জীবন বাঁচাতে অবজারভার ভবনে রাত কাটাতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে পরবর্তীতে লোহানীভাই ও নাজিমুদ্দিন মানিক ভারতে পাড়ি জমান। আমরা থেকে যাই ঢাকাতেই। এসব ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যার পরবর্তী দিনগুলোর কথা। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সামারিক বাহিনী শুরু করে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামের গণহত্যা। হত্যাকাণ্ডের মূল লক্ষ্য ছিল রাজধানী ঢাকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো। হিন্দু ছাত্রদের আবাসস্থল জগন্নাথ হল- যেখানে ৬-৭শ’ আবাসিক ছাত্র নিহত হয়। মধ্য রাতের পর ঢাকা নগরীর কয়েকটি এলাকায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে। অগণিত বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ঘুমন্ত অবস্থায়- পথেঘাটে।

এ পরিস্থিতিতে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যে ঘোষণায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষের প্রতি আহ্বান জানাই, আপনারা যে যেখানেই থাকুন, আপনাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হয়ে ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে আবারও স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয় কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার অন্তর্গত ভবেরপাড়া গ্রামে, যা এখন মুজিবনগর নামে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের অমর স্মৃতির পুণ্যভূমি।

ঢাকায় গণহত্যা চালানোর পর পাকিস্তান বাহিনী এপ্রিলের মধ্যে সারা বাংলাদেশ নিজেদের আয়ত্তে আনার পরিকল্পনা করে। কিন্তু সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা এবং ছাত্র ও সাধারণ মানুষ তাদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পাকিস্তানি হায়েনারা বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। দলে দলে বাংলাদেশের মানুষ বিশেষ করে সংখ্যালঘুরা ভারতে পালাতে শুরু করে। এ সময় প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতের মটিতে আশ্রয় নেয়।

মেহেরপুরের ভবেরপাড়ার নাম হল মুজিবনগর। গঠিত হল বাংলাদেশের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন তাজউদ্দিন আহমদ। কর্নেল এমএজি ওসমানী মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক। বাংলাদেশের সূর্যসৈনিক তরুণরা যোগ দিতে থাকেন মুক্তিবাহিনীতে। শুরু হয়ে যায় মুক্তির যুদ্ধ। সে সময় ভারতের মহীয়সী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এগিয়ে আসেন মায়ের মমতায়। বাংলাদেশের মানুষের সেই চরম দুর্দিনে বন্ধুদেশ ভারত যেভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়েছিল তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে ইতিহাসের পাতায়।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগের এক শ্রেণীর এ দেশীয় কুসন্তান আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। সার্বিক সহযোগিতা করেছিল পাকিস্তানি হায়নাদের। পরিকল্পনা অনুযায়ী বাঙালি কৃতী সন্তানদের হত্যা করার জন্য পাকিস্তানের তাঁবেদাররা রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস নামে বিভিন্ন ঘাতক বাহিনী গড়ে তোলে। তারা এ দেশের মেধাসম্পন্ন বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, ডাক্তার, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী ও সাংবাদিকদের তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।

তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকার এবং জেনারেল ওসমানীর নেতৃত্বে আমাদের মুক্তিবাহিনী সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করে। তাদের সঙ্গে শামিল হয় ভারতীয় সেনাবাহিনী। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে সহায়তা করতে থাকেন সর্বতভাবে। ১৯৭১ সালের এই ডিসেম্বরে মুক্তির সংগ্রাম চরম রূপ ধারণ করে। ব্যাপকতর হতে থাকে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ। অন্যদিকে হানাদার বাহিনী মরিয়া হয়ে চালাতে থাকে নজিরবিহীন ধ্বংসলীলা।

বাংলাদেশের মাটিতে পর্যুদস্ত হতে হতে কোণঠাসা হয়ে পড়ে দখলদার বাহিনী। পিছু হটতে হটতে ঢাকার দিকে জড়ো হতে থাকে ওরা। বাংলাদেশের গণযুদ্ধে মার খেয়ে ১৯৭১-এর ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান বিমানবাহিনী ভারতের ওপর হামলা চালায়। বিমান আক্রমণ শুরু করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। পশ্চিম ফ্রন্টে শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ।

পূর্ব ফ্রন্টে তখন স্থলে-জলে-অন্তরীক্ষে সর্বাত্মক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ কমান্ড- যা মিত্রবাহিনী নামে পরিচিত ছিল। পাকিস্তানিদের পরাস্ত করে ধীরে ধীরে ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে মিত্রবাহিনী। মিত্রবাহনীর প্রধান ছিলেন ভারতীয় জেনারেল মানেক শ। মিত্রবাহিনীর বিমান আক্রমণে নাজেহাল হয়ে পড়ে হানাদার বাহিনী। ৯ ডিসেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মালেক পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে এক বার্তায় জানান, ‘সামরিক পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়েছে।.... বাইরের সাহায্য যদি না আসে, তাহলে শত্রু যে কোনো দিন ঢাকায় পৌঁছে যাবে। আবারও বলছি, আশু যুদ্ধবিরতি অথবা রাজনৈতিক সমাধানের কথা বিবেচনা করুন।’

এ তো গেল গভর্নর মালেকের প্রমাদ। তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী ১০ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন ডেকে তার অসহায়ত্বের কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে বললেন, ‘হাম তারিককে তারহা আপনা কিস্তি জ্বালা চুকে।’ পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিকামী মানুষকে দমন করতে গিয়ে মহাবীর তারিকের মতো নিজেদের সব জলযান জ্বালিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ এখন মাত্র দুটি পথ খোলা আছে, হয় যুদ্ধ করে জয়লাভ অথবা যুদ্ধ করতে করতে মরে যাওয়া- বাঁচার কোনো রাস্তা খোলা নেই। ওই উক্তিটির পর দিন উর্দু পত্রিকা ‘ওয়াতন’-এ ৮ কলামব্যাপী শিরোনাম হয়েছিল।

এশিয়ার দুই দেশ ভারত ও ভুটান ৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ভুটান স্বীকৃতিদানকারী প্রথম রাষ্ট্র, তার কয়েকঘণ্টা পরই ভারতের স্বীকৃতি আসে তার বার্তার মাধ্যমে।

এরপর ১০ ডিসেম্বর গভর্নরের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে জেনারেল নিয়াজির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ঢাকায় জাতিসংঘের প্রতিনিধি পল মার্ক হেনরির কাছে আত্মসমর্পণের আবেদন হস্তান্তর করেন। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সৈন্যরা এ সময় ধীরে ধীরে ঢাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তারা একরকম ঘেরাও করে ফেলেছে ঢাকা। বারবার আত্মসমর্পণের আহ্বান জানাতে থাকে দখলদারদের। আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে বিমান থেকে ছড়ানো হয় হাজার হাজার লিফলেট। বোমাবর্ষণ চলতে থাকে একইসঙ্গে। গভর্নর হাউসের বিভিন্ন টার্গেটে বোমাবর্ষণ শুরু হলে গভর্নর মালেক ভীতসন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়েন। পূর্ব পাকিস্তানের পুতুল সরকারের পদত্যাগ ঘোষণা দিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের নিয়ন্ত্রণাধীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয় নেন।

আত্মসমর্পণের প্রস্তুতির জন্য জেনারেল নিয়াজির অনুরোধে ১৫ ডিসেম্বর বিকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে পরদিন সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত ভারতীয় বিমান অভিযান বন্ধ রাখা হয়। ইতিমধ্যে ভারতীয় মেজর জেনারেল নাগরার বাহিনী কাদের সিদ্দিকীর মিলিশিয়া বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে মিরপুর সেতুর কাছে হাজির হন। সেখান থেকে নিয়াজিকে আত্মসমর্পণের বার্তা পাঠানো হয়। নিয়াজি আত্মসমর্পণে রাজি হলে সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নাগরা বাহিনী ঢাকা শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিল এবং আনুষ্ঠানিকতা চূড়ান্ত করতে ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকব দুপুরের দিকে ঢাকা পৌঁছান। বিকালের আগেই বাংলাদেশ নিয়মিত বাহিনীর দুটি ইউনিটসহ মোট ৪ ব্যাটালিয়ন সৈন্য এবং কয়েক সহস মুক্তিযোদ্ধা ঢাকার রাজপথ দিয়ে রেসকোর্স ময়দানের দিকে এগোতে থাকে। জনাকীর্ণ হতে থাকে ঢাকার রাজপথগুলো। ফুলের মালা গলায় পরিয়ে গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে জনতা অভ্যর্থনা জানাতে থাকে বিজয়ী বীরদের।

আবার পূর্ব কথনে ফিরে যাই। আমরা তখন নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে মতিঝিলের অবজারভার ভবনটি আমাদের রাতযাপনের অবলম্বন হিসেবে ব্যবহার করছি। ইতিমধ্যে আমাদের সহকর্মী আ ন ম গোলাম মোস্তফাকে তার বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করেছে আলবদরের নরপশুরা। নেতৃত্বে ছিল আমাদেরই সহকর্মী আলবদর বাহিনীর অপারেশন প্রধান চৌধুরী মঈনুদ্দিন।

লাল সংকেত পেলাম, আজমল হোসেন খাদেম, চৌধুরী মঈনুদ্দিন ও আমি যেন আর অবজারভার ভবনে না থাকি। সেই দিন ভোর রাতেই আমরা চুপিচুপি অবজারভার ভবন থেকে বের হয়ে হেঁটে বুড়িগঙ্গার পাড়ে চলে যাই। দেশি নৌকার এক মাঝির সহযোগিতায় নদী পার হয়ে প্রথমে বড়িশুড়া, পরে হাঁটতে হাঁটকে রুহিতপুরে পৌঁছি। এরপর ধলেশ্বরী পেরিয়ে যাই হানাদারমুক্ত এলাকা শ্রীনগরের বাসাইলভোগ গ্রামে। সেখানে সাংবাদিক ও ছড়াকার ফয়েজ আহমদের বাড়িতে অবস্থান নিই। সেখানে থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আবার ঢাকায় প্রবেশের পরিকল্পনা করছিলাম।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর কাছে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করল হানাদার বাহিনী। বিকাল ৫টা ১ মিনিটে ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে যৌথ কমান্ডের পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এবং পাকিস্তানের পক্ষে লে. জে. নিয়াজি পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। আমাদের চূড়ান্ত বিজয় ও আত্মসমর্পণে নানা খবর শোনা যাচ্ছিল সেদিন সকাল থেকেই। আর আকাশে মিত্রবাহিনীর জঙ্গি বিমানের সশব্দ মহড়া। সবুজ জমিনে লাল সূর্যের ওপর বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীনতার পতাকা নিয়ে সবাই প্রস্তুত হচ্ছিল সকাল থেকেই, কখন আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি! সন্ধ্যার দিকে রেডিওতে ভেসে উঠল ভারতের মহীয়সী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কণ্ঠস্বর, ‘ঢাকামে পাকিস্তান ফৌজনে আপনা হাতিয়ার ডাল দিয়া।’

এমন দৃশ্য দেখেনি কেউ কোনো দিনও। আমার লেখা ‘একাত্তরের বিচ্ছু বশির’ কিশোর উপন্যাসে সেদিনের আনন্দের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছিলাম, কী আনন্দ সেদিন। মুক্তিবাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা স্টেনগান, এসএলআরের ফাঁকা গুলি তুবড়ির মতো ছুড়ছিলেন আকাশের দিকে। সাধারণ মানুষের বুকচেরা জয়ধ্বনি, জয় বাংলা! বিজয় নিশান হাতে আমরাও সেদিন আনন্দে পাগলপারা। জয় বাংলা ধ্বনি দিতে দিতে ছুটছিলাম বাসাইলভোগ গ্রাম থেকে শ্রীনগর সদরের দিকে। পথে কতবার যে হোঁচট খেয়েছি। ক্ষেতের আলে টলে পড়েছি। হাত ধরে টেনে তুলেছে ভারী শরীরের শক্ত-সমর্থ জওয়ান আজমল হোসেন খাদেম। দৌড়ে বারবার পিছে পড়ে যাচ্ছিলেন ফয়েজভাইয়ের ভাগনে চৌধুরী মাজহার।

আজ মাজহার নেই, ফয়েজভাইও নেই। খুব মনে পড়ছে তাদের কথা। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ বেতারের সংবাদ পরিক্রমার গ্রন্থনাকারী

স্নেহাস্পদ খাদেমের সঙ্গেও দেখা নেই অনেকদিন।

তারপর নতুন দেশে নতুন আশা বুকে নিয়ে প্রত্যাবর্তন। ধলেশ্বরীর স্রোতে নৌকা ভাসিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে হাতের লগি দিয়ে লাশ সরিয়ে স্বাধীন দেশের রাজধানী ঢাকায় ফেরার সেসব স্মৃতি মনে পড়লে আজও চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।

-সময়ের সংলাপ২৪/ডি-এইচ