নতুন সংকট ধেয়ে আসছে বিএনপির দিকে। গত এক যুগে সমস্যা আর সংকটের চাপে পিষ্ট হওয়া এ দলটির সামনে ফের সংকটের পদধ্বনি- যা দলের রাজনীতি ও অস্তিত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিতে পারে। এই সংকটের নাম ‘একুশ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা’। আগামী মাসেই এই মামলার রায় হতে পারে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এই মামলার অন্যতম আসামি। মামলার শুনানিকালে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা চেয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বিশ্লেষণ করে বলছেন, আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা হওয়ার উপাদান রয়েছে এই মামলায়। রায় আসামিদের বিপক্ষে গেলে সাজার পাশাপাশি নৈতিকতার দিক থেকেও রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে বিএনপি। আসামি না হলেও ক্ষমতাসীন মহল থেকে অভিযোগের তীর ছোড়া হচ্ছে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দিকেও। গ্রেনেড হামলার সময় দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। বলা হচ্ছে, তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যার লক্ষ্যে চালানো গ্রেনেড হামলার দায় এড়াতে পারেন না খালেদা জিয়া। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার প্রধান টার্গেট শেখ হাসিনা তো সরাসরিই বলেছেন, ওই হামলার ষড়যন্ত্রে খালেদা জিয়াও জড়িত ছিলেন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় মোট ৫২ জন আসামি। তারেক রহমানসহ মোট ১৯ জন আসামিকে পলাতক দেখানো হয়েছে। পলাতকের তালিকায় নাম রয়েছে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, মাওলানা মো. তাজউদ্দিন, হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ, সাবেক ডিজিএফআই কর্মকর্তা লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার ও মেজর জেনারেল এ টি এম আমিনের। এ ছাড়া জামিনপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে রয়েছেন খালেদা জিয়ার বোনের ছেলে ও তার এপিএস লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, পুলিশের সাবেক আইজিপি মো. আশরাফুল হুদা, খোদা বক্স চৌধুরী ও শহুদুল হকসহ মোট ৮ জন। হাজতি ২৫ জন আসামির নামের তালিকায় রয়েছেন- মুফতি হান্নান মুন্সী, সাবেক উপমন্ত্রী মো. আবদুস সালাম পিন্টু, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. লুৎফুজ্জামান বাবর এবং সাবেক মন্ত্রী ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। মুফতি হান্নান ও আলী আহসান মুজাহিদের অন্য মামলায় ইতোমধ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে।
৩৯ বছর পার করে আগামী ১ সেপ্টেম্বর ৪০ বছরে পা দিচ্ছে বিএনপি। আর সেই মাসেই দলটির গুরুত্বপূর্ণ নেতা বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ঘোষণা হতে পারে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়, যা বিএনপির জন্য একটি বড় ধরনের বিপর্যয়েরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যেও বিষয়টি স্পষ্ট। বিএনপিও তাদের সাম্ভাব্য বিপদ আঁচ করতে পেরে তা মোকাবেলায় ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিষয়ে খালেদা জিয়ার নির্দেশ নিতে ইতোমধ্যেই কারাগারে তার সঙ্গে দেখা করেছেন। খালেদা জিয়া দলের প্রতিটি নেতাকর্মীকে এ বিষয়ে সজাগ ও ঐক্যবদ্ধ থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। দলকে এক্যবদ্ধ রাখতে নানা প্রক্রিয়াও চালাচ্ছে বিএনপি।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় সামনে রেখে এরই মধ্যে বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রতিপক্ষ বিএনপির নেতারা। ক্ষমতাসীনরা বলছেন, সেই গ্রেনেড হামলায় শুধু তারেক রহমানই নন; বিএনপি চেয়ারপারসন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াও জড়িত। আর বিএনপির পক্ষ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপিকে ঘায়েল করতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব কথা বলছেন। তাদের বক্তব্য মামলার রায়কে প্রভাবিত করবে।
গত ২১ আগস্ট মঙ্গলবার রাজধানীতে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলা স্মরণে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এ হত্যাযজ্ঞে খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমান সরাসরি জড়িত, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এরপরই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, রায় সামনে রেখে যখন রাষ্ট্রের চিফ এক্সিকিউটিভ এ ধরনের একটা কথা বলেন, তখন বিচারকদের পক্ষে ন্যায়বিচার করা অসম্ভব হয়ে যায়। আমরা মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য গ্রেনেড হামলা বিচারে প্রভাব ফেলবে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, এই মামলার বিচার শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এই রায়ের পর বিএনপি নতুন করে সংকটে পড়বে। গতকাল শনিবার তিনি বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার দায় বিএনপি এড়াতে পারে না। এই কিলিং মিশনের টার্গেট ছিলেন শেখ হাসিনা। এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডে আইভি রহমানসহ ২৪ জনের প্রাণ গেছে। তখন বিএনপি সরকার ক্ষমতায়। হাওয়া ভবনের পরিকল্পনার কথা সারা দেশ জানে। গোপন কোনো বিষয় নেই। শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার এই মামলায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও আসামি।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা নিয়ে সরকারের বক্তব্যে ফরমায়েশি রায়ের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় নিজেরা (সরকার) লিখে আদালতকে দিয়ে তা বাস্তবায়ন করাবেন কিনা মানুষের মনে সেই সংশয় এখন দেখা দিয়েছে। মানুষ সেটাই ভাবছে। আমাদের প্রশ্ন- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদের একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়কে প্রভাবিত করতেই খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে নিয়ে বেসামাল বক্তব্য রাখছেন। আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকারের পক্ষ থেকে এই বক্তব্য সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিতবাহী বলেও মনে করেন রিজভী।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগ আয়োজিত সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে ভয়াবহ বর্বরোচিত ও নৃশংস গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। ওই নৃশংস হামলায় ২২ জন নিহত ও নেতকর্মী-আইনজীবী-সাংবাদিকসহ পাঁচ শতাধিক লোক আহত হয়। নিহতদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের পত্নী আইভি রহমান। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের প্রথম সারির অন্যান্য নেতা এই গ্রেনেড হামলা থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। এতে শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও গ্রেনেডের প্রচণ্ড শব্দে তার শ্রবণশক্তিতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়।-ভোরের কাগজ
-সময়ের সংলাপ২৪/ডি-এইচ