কক্সবাজার-টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়কে র্যাবের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ তিনবারের নির্বাচিত পৌর কাউন্সিলর ও উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি একরামুল হকের মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না পরিবার ও রাজনৈতিক সহকর্মীরা। তাদের দাবি- এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
ঘটনার ৬ দিনের মাথায় নিহত একরামুল হকের স্ত্রী আয়েশা বেগম, দুই মেয়ে তাহিয়াত ও নাহিয়ান কক্সবাজার প্রেস ক্লাবে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ফোনের অটো রেকর্ডারে রেকর্ড হওয়া চারটি ক্লিপ সাংবাদিকদের শোনান।
এতে কয়েকজনের কণ্ঠ, গুলির শব্দ আর চিৎকার শোনা যায়। এ রেকর্ড শুনিয়ে একরামের স্ত্রী অভিযোগ করেন, তার স্বামীকে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে ‘পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
একরামের পরিবারের দেয়া অডিও যুগান্তর স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি। আয়েশার দাবি ঘটনার সময় একরামের ফোনে তার মোবাইল থেকে কল দিলে সেটি রিসিভ হলেও কোনো উত্তর আসেনি, পুরো ঘটনাপ্রবাহ অটো রেকর্ডারে রেকর্ড হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে একরামকে ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে হত্যার অভিযোগ তুলে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করেন তার স্ত্রী আয়েশা বেগম। পাশাপাশি স্বামী হত্যার সুবিচার প্রার্থনা করেন প্রধানমন্ত্রীর কাছেও।
আয়েশা বেগম যুগান্তরকে বলেন, আমার স্বামী একরামুল হক ১৩ বছর টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন এবং তিনবার নির্বাচিত পৌর কাউন্সিলর। আর ব্যক্তিজীবনে সে কেমন মানুষ ছিলেন সবাই জানে।
ইয়াবা ব্যবসা দূরের কথা জীবনে কখনও কোনো অপরাধমূলক কাজে জড়ায়নি। একরাম সম্পূর্ণ নির্দোষ। তাকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে, যার চারটি অডিও রেকর্ড ইতিমধ্যে সাংবাদিকদের দেয়া হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে আয়েশা বলেন, ২৬ মে রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিয়ে একরামকে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় আমার স্বামী মোবাইলে আমার মেয়ে ও আমার সঙ্গে কথা বলেন। তখন তার কণ্ঠে আতঙ্ক ছিল।
এরপর থেকে আমার মোবাইলটি সারাক্ষণ খোলা ছিল। এতে রেকর্ড হচ্ছিল। ওই দিন রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চিৎকার ও গুলির শব্দ শুনেই আমি ও আমার পরিবার আঁতকে উঠি। তখনই বুঝতে পারি আমার স্বামীকে অন্যায়ভাবে গুলি করে হত্যা করেছে র্যাব।
এদিকে একরামুল হকের সঙ্গে র্যাবের বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না বলে জানালেন টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলী ও সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর।
তাদের দাবি- র্যাবের এ অভিযানে ভুল ছিল। তা না হলে একরামের মতো রাজনৈতিক কর্মী কখনও বন্দুকযুদ্ধে নিহত হতো না। অভাব-অনটন নিয়ে যার জীবন কাটে সে কখনও মরণনেশা ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে না।
কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও কক্সবাজার পৌর মেয়র মাহাবুবুর রহমান চৌধুরী তার ফেসবুক পেজে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে লিখেছেন- ‘মা, সারা দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযানকে যখন দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা স্বাগত জানিয়েছেন; ঠিক তখনই আপনার এ সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ওঠে-পড়ে লেগেছে প্রশাসনের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা একাত্তরের দোসররা। তারা ইয়াবাবিরোধী অভিযানের দোহাই দিয়ে আপনার সন্তানকে হত্যা করছে। ২৭ মে গভীর রাতে টেকনাফে এমনই একটি ঘটনা ঘটেছে।
প্রশাসনকে ভুল তথ্য দিয়ে আজন্ম আওয়ামী লীগ পরিবারের অহঙ্কার টেকনাফ যুবলীগের সাবেক সভাপতি ও পরপর তিন-তিনবার নির্বাচিত কাউন্সিলর একরামকে হত্যা করা হয়েছে। মাগো, এমন চলতে থাকলে আওয়ামী লীগ তথা বাংলাদেশ নিঃশেষ হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। ...যার চাল-চুলো নেই, থাকার জন্য বাড়ি নেই। পরিবার ও সন্তানদের লেখাপড়া চালানোর জন্য যাকে নির্ভর করতে হয় ভাইদের ওপর, বন্ধুদের ওপর।
আওয়ামী লীগকে ভালোবেসে জনগণকে সেবা করতে গিয়ে দেনার দায়ে যার সব শেষ, তাকে বানানো হচ্ছে ইয়াবা গডফাদার! ...মাগো, আমি আমার কান্না রুখতে পারছি না।
একরামের মৃত্যুতে আমার হৃদয়ে ক্ষণে ক্ষণে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এ হত্যা মানতে পারছি না। মা, এখনও সময় আছে, লাগাম টেনে ধরো তাদের। যারা প্রকৃত মুজিব আদর্শের সৈনিকদের হত্যা করার পরিকল্পনা করেছে।’
টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ রণজিত কুমার বড়–য়া বলেন, ২৬ মে রাতে র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত কাউন্সিলর ও সাবেক যুবলীগ সভাপতি একরামের নামে থানায় কোনো মাদক কিংবা জিআর মামলা নেই। তবে নিহতের পর র্যাব বাদী হয়ে হত্যা, অস্ত্র ও ইয়াবাসহ তিনটি মামলা করেছে।
-সময়ের সংলাপ২৪/ডি-এইচ