মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সর্বজনস্বীকৃত বিশ্বজনীন ধর্ম ইসলাম। প্রতিবন্ধীরা যেহেতু মানবজাতির অংশ তাই সুস্পষ্টভাবেই এ কথা ভাবা যায়, ইসলাম তাদের ব্যাপারে অবশ্যই বিশেষ ব্যবস্থাপনার কথা বলবে এবং তা বিশেষভাবে পালনের তাগিদ প্রদান করবে।
এ কথা খুবই স্বাভাবিক, কোনো সভ্য সমাজ প্রতিবন্ধীদের নগণ্য করে কিংবা জীবনযাপনের সম্মানযোগ্য অবস্থান থেকে আলাদা করে রাখার ধারণাও করতে পারে না।
একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট, সামাজিক জীবনে সাধারণ ব্যক্তিরা যেসব অধিকারের যোগ্য সমাজের অংশ হিসেবে প্রতিবন্ধীরাও একই অধিকার পাওয়ার যোগ্য। সাধারণ স্বীকৃত অধিকার ছাড়াও ইসলাম প্রতিবন্ধীদের যেসব বিশেষ অধিকার দিয়েছে তা নিয়ে আজকের লেখা।
সভা-সমাবেশে তাদের জন্য বিশেষ কিছু : জীবনের সব কর্মকাণ্ডে প্রত্যেক ব্যক্তিকে বর্ণ, বংশ ও সামাজিকভাবে পার্থক্যহীন সমান মর্যাদা দেয়া হয়েছে। আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, প্রতিবন্ধীদের জীবনের সাধারণ লেনদেন ও মেলামেশায় পিছিয়ে রাখা। পবিত্র কোরআনুল হাকিমে আল্লাহতায়ালা এ দৃষ্টিভঙ্গির তীব্র নিন্দা করে মানবাত্মার মাহাত্ম্য ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছেন।
প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) মুশরিক নেতাদের ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছিলেন, এ সময় অন্ধ সাহাবি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.) তাঁর খিদমতে উপস্থিত হলেন। অন্যদের সঙ্গে কথাবার্তায় ব্যস্ত থাকায় নবীজি (সা.) আব্দুল্লাহ ইবনে মাকতুমের প্রতি খেয়াল করেননি এ বিষয়কে উপলক্ষ করে আয়াত নাজিল হলে তার চেহারায় বিষণ্ণতা প্রকাশ পেল এবং (নুরানি) মুখ ফিরিয়ে নিলেন, এ কারণে যে, তার কাছে এক অন্ধ উপস্থিত হয়েছে (যে তার কথার মাঝখানে প্রশ্ন করে বসেছে)। আপনার কি জানা আছে? হয়তো সে (আপনার দৃষ্টিতে আরও) পবিত্র হতো। কিংবা (আপনার) উপদেশ গ্রহণ করত, অতঃপর উপদেশ তাকে (আরও) উপকৃত করত (সূরা আবাসা, আয়াত নং ১-৪)
এ বরকতপূর্ণ আয়াতের মাধ্যমে প্রিয় নবীজি (সা.)-এর উম্মতদের এ শিক্ষা দেয়া হয়েছে- ১. অক্ষম ব্যক্তিরা চলাফেরায় অন্য লোকদের তুলনায় বেশি সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়ার অধিকারী। তাদের অন্যান্য লোকদের ওপর অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং তাদের এড়িয়ে চলা যাবে না।
মান-মর্যাদা নির্ধারণ সামাজিক অবস্থান কিংবা চাল-চলন দেখে করা যাবে না বরং এর জন্য ব্যক্তিত্ব, খোদাভীরুতা, আত্মশুদ্ধি ও পুণ্যের আবেগ-স্পৃহার মানদণ্ড মেনে করতে হবে।
মেলামেশায় নীতি ভিন্নতার অধিকার : অন্যান্য বিষয়ের মতো জীবনযাত্রা ও মেলামেশার ক্ষেত্রেও বিশেষ নীতি ও শৃঙ্খলা দিয়েছে। দৈনন্দিন লেনদেন, আত্মীয়দের সঙ্গে সদ্ভাব ও প্রিয়জনদের ঘরে আসা-যাওয়ার সুস্পষ্ট বিধান দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়টি বিশেষভাবে চিন্তাযোগ্য, কোরআনুল কারিমে প্রতিবন্ধীদের ওই নীতিমালা থেকেও স্বতন্ত্র রাখা হয়েছে। পবিত্র কোরআনুল কারিমে বর্ণিত হয়েছে- অন্ধের জন্য বাধা-বিপত্তি নেই, আর না খোঁড়াদের কোনো অসুবিধা আছে, না রুগ্নদের কোনো গুনাহ হবে এবং তোমাদের মধ্যে কারও জন্য (বাধা আছে) এতে যে, তোমরা খাবে সন্তানদের ঘরে অথবা পিতার ঘরে, মাতার ঘরে, ভাইয়ের ঘরে, বোনদের ঘরে, চাচাদের ঘরে, ফুফুদের ঘরে, মামাদের ঘরে, খালাদের ঘরে অথবা যেসব ঘরের চাবিগুলো তোমাদের হাতের মুঠোয় রয়েছে, অথবা প্রিয় বন্ধুদের ঘরে; তোমাদের প্রতি এ ব্যাপারে কোনো গুনাহ নেই একত্রে খাওয়া দাওয়া খেলে অথবা ভিন্নভাবে; অতঃপর যখন তোমরা কোনো ঘরে প্রবেশ কর তখন তোমরা তাদেরকে (পরিবারবর্গকে) সালাম দাও।
সাক্ষাতের সময় মঙ্গল কামনা কর (যা) আল্লাহ থেকে কল্যাণময়, পবিত্র। এভাবেই আল্লাহ পাক আয়াতগুলো বিশদভাবে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা (শরয়ী বিধান ও জীবনাচার) বুঝতে পার। (সূরা আন নূর, আয়াত নং ৬১)
জিহাদ ও প্রতিরক্ষামূলক দায়িত্ব বর্জনের অধিকার : পবিত্র কোরআনে ইসলামী নেতৃত্বের সম্প্রসারণ ও সত্য দ্বীনের বিজয় প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার লক্ষ্যে জিহাদে অংশগ্রহণকে ইমান ও ইস্তিকামাত (অটলতা) পরীক্ষার মূল মানদণ্ড হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং এ মৌলিক দায়িত্ব এড়িয়ে চলাকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু অক্ষম বিকলাঙ্গদের এ মহান মৌলিক জিম্মাদারি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
ইরশাদ হচ্ছে, না অন্ধের জন্য কোনো অপরাধ আছে, না খোঁড়া ব্যক্তির জন্য কোনো পাপ রয়েছে, না ব্যাধিগ্রস্তের ওপর কোনো জবাবদিহিতা আছে (যে তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেনি)। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর আনুগত্য করে, আল্লাহ তাকে এমন বাগানগুলোয় নিয়ে যাবেন, যেগুলোর নিচ দিয়ে নহর প্রবাহমান এবং যে ফিরে যাবে তাকে বেদনাদায়ক শাস্তি দেবেন। (সূরা আল ফাতাহ, আয়াত নং ১৭)
সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর এ কথাও বলা যেতে পারে, ইসলামী আইন প্রতিবন্ধীদের জন্য দায়িত্ব-কর্ম বর্জনকে তাদের মৌলিক অধিকার বলে ঘোষণা করেছে। ইসলামের নৈতিক শিক্ষায় এসব বিষয় সুস্পষ্ট-
* প্রতিবন্ধীদের সামাজিক জীবনে একটি সম্মানযোগ্য অংশ হিসেবে বিবেচনার শিক্ষা দিয়েছে ধর্ম।
* বিকলাঙ্গদের বিশেষভাবে দেখাশোনা করতে হবে এবং জীবনের কোনো ক্ষেত্রে কোনোভাবেই তাদের আলাদা রাখার ধারণা করা যাবে না।
* পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে তাদের ওপর এমন কোনো দায়িত্ব চাপানো যাবে না, যা পালন করা তাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়।
* যাবতীয় অধিকার আদায়ে অক্ষমদের অগ্রাধিকার দিতে হবে যাতে করে জীবনযাপনে তাদের সুবিধা প্রাপ্তিতে কোনো ধরনের বাধা না থাকে। এ সবই হল ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
-সময়ের সংলাপ২৪/ডি-এইচ