নিউজ ডেস্ক: গত ২৪ আগস্ট দিনগত রাতে রাখাইনে যখন পুলিশ ক্যাম্প ও একটি সেনা আবাসে বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। এর জেরে ‘অভিযানের’ নামে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী নিরস্ত্র রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুদের ওপর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। ফলে প্রাণে বাঁচতে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের শরণার্থী শিবিরগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে লাখো রোহিঙ্গা, তাদের মধ্যে অধিকাংশ শিশু।
রোহিঙ্গা শিশুদের নিবন্ধন, খাবার, স্বাস্থ্যসেবা, টেকনাফে প্রবেশের পর তাদের ক্যাম্পে পাঠানো, নিরাপত্তা দেয়াসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এমনকি রোহিঙ্গা ক্ষুধার্থ শিশুর মুখে খাবার তুলে দিয়ে পরম মমতায় আগলে রাখছেন অনেক সেনা সদস্য।
এদিকে শরণার্থী শিবিরগুলোতে আশ্রয় নেয়া শিশুদের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। সরেজমিন দেখা যায়, টেকনাফের নয়াপাড়ার অস্থায়ী ক্যাম্পে কাজ করছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। বাংলাদেশের মংডু সীমানা দিয়ে শাহপরীর দ্বীপ হয়ে টেকনাফ সীমান্তে ডুকছে রোহিঙ্গারা। প্রতিদিন এ ক্যাম্প দিয়ে প্রায় তিন হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। টেকনাফে প্রবেশ করার পর সেনা সদস্যরা রোহিঙ্গাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিচ্ছেন।
নারী ও শিশুসহ সব রোহিঙ্গার নিবন্ধন শেষে স্বাস্থ্যসেবা ও শুকনা খাবার, পানি, খাবার সেলাইন ও ওষুধ দেয়া হচ্ছে। পরে গাড়িতে তাদের শরণার্থী শিবিরগুলোতে পাঠানো হচ্ছে। মিয়ানমার থেকে টেকনাফ সীমান্তে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে নারী ও শিশুদের অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ। সব ক্যাম্পেই শিশু ও নারী রোগীর সংখ্যা বেশি।
রোহিঙ্গা শিশুদের বিষয়ে নয়াপাড়া ক্যাম্পে কর্মরত সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা মেজর নাজিম আহমেদ বলেন, আমরা কার্যক্রম শুরু করার পর এ পর্যন্ত এ ক্যাম্পে ১১ হাজার রোহিঙ্গাকে স্বাস্থ্যসেবা দিয়েছি। তাদের মধ্যে ৮০ ভাগ নারী ও শিশু। আর অন্তঃসত্ত্বা ও প্রসূতি নারীর সংখ্যা অনেক। তাদের আমরা উপজেলা সদর হাসপাতালে পাঠাচ্ছি।
তিনি আরও জানান, প্রতিদিন এ রুটে তিন হাজারের বেশি রোহিঙ্গা প্রবেশ করছে। শুক্রবার এদের সংখ্যা ছিল বেশি। ১৫ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা এসেছে এ সীমান্ত দিয়ে। যাদের মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা নারীর সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় হাজারের মতো। এ ছাড়া কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, থ্যাংখালী, পালংখালী ক্যাম্পগুলো ঘুরে একই চিত্র দেখা গেছে।
টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পে শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন সেনাবাহিনীর সদস্য তারেক রাব্বী লিখন। তিনি বলেন, টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি নারী ও শিশু রোগী। তাদের সংখ্যা ৮০ ভাগ। বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি বিনা মূল্যে ওষুধও দেয়া হচ্ছে রোহিঙ্গাদের। যাদের অবস্থা বেশি খারাপ তাদের উপজেলা সদর হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে।
ওই সেনা সদস্য আরও জানান, শূন্য থেকে ৫ বছরের বাচ্চাদের টিকা (ভেকসিনেশন) দেয়া হচ্ছে ও ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো হচ্ছে। এ ছাড়া ৫ বছরের অধিক বয়সী শিশুদের পোলিও ধনুষ্টংকার, রুবেলাসহ বিভিন্ন রোগের টিকা দেয়া হচ্ছে।
নয়াপাড়া ক্যাম্পে এক শিশুর মুখে খাবার তুলে দিচ্ছিলেন সেনা সদস্য কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা শিশুদের দেখলে আমার সন্তানের কথা মনে পড়ে যায়। আল্লাহ তাদের হেফাজত করুন।
শনিবার সরেজমিন কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, থ্যাংখালী, পালংখালী, টেকনাফের নয়াপাড়াসহ বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ঘুরে দেখা গেছে, শরণার্থী শিবিরগুলোতে আগে বিশৃঙ্খলা দেখা গেলেও ২৩ সেপ্টেম্বর সেনা নিয়োগের পর থেকে শৃঙ্খলা ফিরেছে প্রতিটি ক্যাম্পে। প্রতিটি শরণার্থী শিবিরের পাশেই সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প বসানো হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা, বিশুদ্ধ খাবার পানি, স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেটসহ সব ধরনের কার্যক্রমে রোহিঙ্গাদের মধ্যে শৃঙ্খলা আনতে কাজ করছে সেনারা। ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবাসহ সব ক্ষেত্রেই কাজ করছে সেনারা।
প্রসঙ্গত, সহিংসতার শিকার হয়ে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় সোয়া চার লাখ। তবে বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা সাড়ে পাঁচ লাখ ছাড়িয়েছে। সহিংসতায় প্রাণ গেছে তিন হাজারের বেশি মানুষের। বেসরকারিভাবে এই সংখ্যা দশ হাজার পার করেছে মধ্য সেপ্টেম্বরেই।